সর্বশেষ সংবাদ
সম্ভবত ১৯৯৮-৯৯ এর দিকে আমি যখন ক্লাস ৪-৫ এ পড়ি তখন আমার আব্বা আম্মা আমার জন্য একজন প্রাইভেট টিউটর ঠিক করে দেন, মোবারক স্যার। তিনি আমাকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত পড়িয়েছেন, সম্ভবত ক্লাস ৮-৯ পর্যন্ত। কি পড়িয়েছিলেন, কিভাবে পড়িয়েছেন, মারতেন কিনা এইসব কিছুই আমার মনে নেই। তবে মনে আছে স্যার আমাকে সংসদ ভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন, এর ডিজাইন, ডিজাইনার সম্পর্কে বলেছিলেন সংসদ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে (ছবি-১)। তার আরও কিছু স্টুডেন্ট সহ আমাকে আগারগাঁও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিমি মাছের কংকাল, সৌর ঘড়ি, বয়ামে রাখা নানারকম অদ্ভূত স্পেসিমেন দেখে আমার আনন্দ আকাশ ছুয়ে ছিলো (ছবি-২)। আমার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ, বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মানোতে স্যার শতভাগ সফল ছিলেন।
কোন ক্লাসে ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ক্লাস ৬-৮ এর কোন একটা বিজ্ঞান বইতে সালফার আর লোহার গুড়োর বিক্রিয়ায় ফেরাস সালফাইড তৈরির কথা লেখা ছিলো। চুম্বক কাগজে পেচিয়ে বালিতে ঘুরালে লোহার গুড়ো জমা হয় আর সে সময়ে দোকানে সালফার কিনতে পাওয়া যেত গন্ধক নামে। দুটোই যোগাড় করে বাসায় চুলার উপর ছোট্ট কড়াইতে এই দুই বস্তু মিশিয়ে বিক্রিয়া ঘটানোর চেস্টায় সারা ঘর ধোয়ায় ভরে ফেলেছিলাম এবং যথারীতি কিল একটাও মাটিতে পড়ে নাই কিন্তু জ্ঞানের আগ্রহও মাটিতে পড়ে নাই।
ঠিক সেই সময়েই হাতে পাই জাফর ইকবাল স্যারের বিজ্ঞানের ১০০ মজার খেলা নামের একটা বই। ঘরে বসে করা যায় এমন ছোট ছোট ১০০ টার মত এক্সপেরিমেন্ট এর তালিকা ছিলো। সেই তালিকা দেখে লিস্ট করতাম উপকরণের। মোবারক স্যার আমাকে নিয়ে যেতেন টিকাটুলির সায়েন্টিফিক ইন্সট্রুমেন্ট এর দোকান গুলোতে। বিকার, টেস্টটিউব, রেত, ফানেল, কর্ক, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ইত্যাদি কিনে আনতাম জাফর ইকবাল স্যারের বইতে লেখা এক্সপেরিমেন্টগুলো নিজে করে দেখতে।
ক্লাস এইটে সম্ভবত স্কুলের লাইব্রেরি থেকে একটা বই পেলাম ইলেক্ট্রনিক্সে হাতে খড়ি বা কাছাকাছি কোন একটা নামের এক বই। বিজ্ঞানের একটা নতুন জগত উন্মোচিত হলো আমার সামনে। সার্কিট বোর্ড, ক্যাপাসিটর, ডায়োড ইত্যাদি কি, কিভাবে কাজ করে সব বুঝতে শিখলাম। ছোট বোনের পুতুলের, পুরোনো রেডিওর সার্কিট বোর্ড খুললাম, কোনটা কি বোঝার চেস্টা করলাম, আম্মা দেখে ফেলে পিঠে দুমদাম কিল মেরে বসলেও আগ্রহ কমাতে পারে নাই!
স্কুলে নবম শ্রেণীতে একজন বায়লজি স্যার ছিলেন, সম্ভবত নুরুল হক স্যার। স্যার খুব রাগী ছিলেন এবং ছাত্রদের মারতেন। নিঃসন্দেহে সেটি খারাপ কাজ ছিলো কিন্তু আমি তাকে সেজন্য মনে রাখিনি। একদিন নুরুল স্যার বললেন তোদের কার কার বাসা মাদারটেক নন্দীপাড়া এলাকায়। আমি হাত তুললাম বোকার মত। স্যার বললেন তোকে এক সপ্তাহ সময় দিলাম, রাজারবাগ পুকুরে যাবি, ওইখানে দেখবি পুকুর পাড়ে, পানির নিচে কিছু গাছ আছে, এইগুলো পানির নিচেই থাকে। এমন কয়েকটা গাছ টেনে তুলে হরলিক্স এর কাচের বয়ামে নিয়ে আসবি। বয়াম এর কাগজ খুলে ফেলবি যেন বাইরে থেকে দেখা যায়। বহু কস্ট করে এই জিনিস যোগাড় করলাম। পরের ক্লাসে স্যার সেই স্বচ্ছ বয়ামে ভরা জলজ গাছ রোদে রেখে দেখালেন বুদবুদ তৈরি হচ্ছে, সালোকসংশ্লেশনের মাধ্যমে অক্সিজেন তৈরি হবার কারনে।
ক্লাস নাইন-টেনে শহীদবাগ এলাকায় একটা কোচিং সেন্টারে পড়তাম৷ রেগুলার পড়াশোনা, মডেল টেস্ট ফেস্ট ইত্যাদি ছিলো কিন্তু এর বাইরেও একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, কোচিং সেন্টারে একটা কেমিস্ট্রি ল্যাব আছে, আর আছে একটা লাইব্রেরি যেখান থেকে ফিকশন নন ফিকশন নানা ধরনের বই ধার নেয়া যায়। আমি কোচিং এর ল্যাব থেকে কিছু এমোনিয়াম নাইট্রেট আর সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড বাসায় এনে হাবিজাবি এটা ওটা মিশিয়ে দেখার চেস্টা করলাম কি ঘটে। কি এক আজব খেয়ালে একবার এমোনিয়াম নাইট্রেট জিভের ডগায় ছোয়ালাম।
এরপর বুঝতে পারলাম গুগল সার্চে এমোনিয়াম নাইট্রেটের বর্ণনায় লেখা Strong disagreeable acrid taste এর মানে কি! তিনদিন ঠিকমত খেতে পারিনি সেই ঘটনার পর!আমি ঠিক জানিনা আমাদের এখনকার স্কুল কলেজ, কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরেরা এই ধরনের প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষায় উৎসাহ দেয়ার কোন ব্যবস্থা নেন কিনা। এই লেখার শুরুতে বলা ঘটনাটি সত্য হয়ে থাকলে সেই সম্ভাবনা ক্ষীন বলেই মনে হয়। যে জাফর ইকবাল স্যারের সায়েন্স ফিকশন, কিশোর উপন্যাস, আর প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট এর বই পড়ে আমি বিজ্ঞানে আগ্রহী হয়েছি, সেই জাফর ইকবাল স্যার এখন ছাত্র ছাত্রীদের কাছে একটি ঘৃণ্য নাম স্রেফ পলিটিসাইজেশন এর কারনে।
যে কোনদিনও স্যারের এই বইগুলো পড়েনি, সেই তার বই এর কপি পেস্ট সমালোচক, তাকে "ষাড়" বলে ডেকে স্বমেহনী সুখ পায়। যে মাদ্রাসা ছাত্রটি কোনদিন তার বই না পড়ে স্রেফ বই এর নাম শুনেই তার উপর ছুরি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলো তার চিন্তা ধারার সাথে এইসব সমালোচকদের তেমন কোন পার্থক্য নেই। আমার সময়ে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো না কিন্তু বাস্তবে সেই শিক্ষা অনেক বেশি সৃজনশীল ছিলো যেটা আমি হাতে কলমে পেয়েছি। এখনকার শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কি এমন কিছু করেন?
আমাদের স্কুল কলেজগুলোতে যদি বিসিএস প্রস্তুতি আর সরকারি চাকুরীর মোহের বীজ বপন করা হয় তাহলে এই শিক্ষার কোন মূল্য নেই।
এই দেশ থেকে কোনদিন গবেষক, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, সমাজ সংগঠক তৈরি হবেনা। তৈরি হবে একদল "ম্যানেজার", সরকারি অফিসার যারা তাদের মুখস্তবিদ্যার দাম্ভিকতায় বিসিএস উতরে নিজেদের নতুন প্রজাতির উন্নত মানবশ্রেণী মনে করবে এবং উন্নয়নের জিকির করে অবনবনের কালিমা মুছে দেবে। এটাই তো আমরা এখন চাই, নাকি?
ডা. মোঃ মারুফুর রহমান
চিকিৎসক ও পিএইচডি গবেষক
ডিপার্টমেন্ট অফ অনকোলজি এন্ড মেটাবলিজম
দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ড, যুক্তরাজ্য
এসএম
Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.
উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ
কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল