জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক:
শেখ কামালের জীবন থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের যুব সমাজ নিজেদের মেধা-মনন বিকশিত করে বাংলাদেশের মর্যাদা উন্নত করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বহুমুখি প্রতিভা নিয়ে সে জন্মেছিল। হয়তো বেঁচে থাকলে আরও বেশি উন্নতি করতে পারত।
সিম্পল লিভিং, হাই থিংকিং, এটাই ছিল আমাদের মটো (আদর্শ)। কামাল সব সময় অত্যন্ত সাদাসিধাভাবে চলাফেরা করতো। তার পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবন-যাপন খুবই সীমিত ছিল। এমন কী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির ছেলে বা প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে কোনো অহমিকা ছিল না তার। এটা আমার মা-বাবা কখনও চাননি। খুব সাধারণভাবে জীবনে চলা, এটাই ছিল তার লক্ষ্য।
আজ (শুক্রবার) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন এবং শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার-২০২২ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ সব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছিলেন।
পরিবারে খেলাধুলার ঐতিহ্য থাকার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেন, আমার দাদা ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন। আমার ছোট দাদা শেখ হাবিবুর রহমান। তিনিও ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন। আমার বাবাও ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন। অফিস শেষে আমার দাদাও যেমন খেলতেন, আমার আব্বাও খেলতেন। তাদের মধ্যে কম্পিটিশন হতো।
তিনি বলেন, খেলাধুলায় আমাদের দেশের যুব সমাজ যেন আরও সম্পৃক্ত হয়, কিশোর-কিশোরীরা যেন সম্পৃক্ত হয় তার জন্য তিনি উদ্যোগী ছিলেন। আজকে কামালের জন্মদিন। বহুমুখি প্রতিভার অধিকারি ছিল সে। একাধারে হকি খেলতো, ফুটবল খেলতো। আবার সেতার বাজাতো। ভালো ছাত্র ছিল। ভালো গান গাইতে পারত। নাটকে অংশগ্রহণ করতো। অনেক নাটক তার করা আছে। উপস্থিত বুদ্ধি তার ছিল, সব সময় পুরস্কার পেত।
ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্কুল পাস করে যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হলো, তখন থেকে সে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। আমরা সবাই সংগঠন করতাম। কখনও কোনো পদ নেওয়ার চিন্তা আমাদের ছিল না। আমার বাবা এদেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেন, তার আদর্শ নিয়ে আমরা পথ চলতাম। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন সাদাসিধা জীবন-যাপন করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণে জাতির পিতা যে ঘোষণা দিয়েছেন সেই ভাষণকে সামনে রেখে প্রত্যেকটা এলাকায় আমাদের নেতাকর্মীরা সংগঠিত হচ্ছিল। কারণ তিনি বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে, তাই প্রত্যেকটা এলাকায় একটি সংগঠন গড়তে। কামাল সব চেয়ে বেশি কাজ করতো ১৯ নম্বর রোড, আবাহনী ক্লাব এবং সাতমসজিদ রোডে। যুব সমাজকে নিয়ে সে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতো।
একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোর বর্ণনা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। সেই সময় জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যেটা ২৪ মার্চে প্রথম প্রহরে সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের এখন যে বিজিবি তখনকার ইপিআরের মাধ্যমে এবং পুলিশের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রাতে আমাদের বাসায় আক্রমণ করে। বাবাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। বাসা সম্পূর্ণ ভেঙে-চুড়ে রেখে যায়।
তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় দিন আবার আক্রমণ করে। বাবাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে শুনে কামাল আবাহনী ক্লাবের ওখান থেকে প্রায় ৫০টা ওয়াল টপকে মাকে দেখতে আসে। তখন কারফিউ ছিল। পাশের বাসা থেকে ডা. সামাদ সাহেব আমার মাকে আর রাসেলকে ওখানে নিয়ে যান। ২৫ তারিখ রাতে আব্বা আমাদের অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কামাল সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। কামাল মুক্তিযুদ্ধে যখন যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেছিলেন লেখাপড়ার জন্য তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে, কামাল কিন্তু সেটাতে রাজি হয়নি। কামাল বলেছে, আমি যুদ্ধ করতে এসেছি, আমি ট্রেনিং নেব। দেরাদুনে প্রথম কোর্সে সে ট্রেনিং নেয় এবং যুদ্ধে যায়। পরবর্তীতে তাকে কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কামাল এবং নূর একই সাথে কর্নেল ওসমানীর এডিসি ছিল।
তিনি বলেন, নিয়তির কী পরিহাস ১৫ আগস্ট নূরই প্রথম আসে। ফারুকের নেতৃত্বে যে গ্রুপটা আমাদের ৩২ নম্বরের বাড়ি আক্রমণ করে সেখানে কর্নেল নূর-হুদা এরা ছিল। কামাল মনে হয় কিছু ধোকায় পড়ে গিয়েছিল তাকে দেখে। ভেবেছিল তারা বোধহয় উদ্ধার করতে এসেছে। কিন্তু তারা যে ঘাতক হয়ে এসেছে সেটা বোধহয় জানতো না। কারণ প্রথমে তারা কামালকে হত্যা করে। এরপর একে একে পরিবারের সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
সরকারপ্রধান বলেন, আমার বাবা ক্ষমতায় ছিলেন সত্যি, কিন্তু আমরা কখনও এই ক্ষমতাটাকে বড় করে দেখিনি। এটা আমার মা-বাবার শিক্ষা ছিল না। আমার আব্বা ৩২ নম্বরের বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আজ কামাল আমাদের মাঝে নেই। আধুনিক ফুটবল খেলা, আবাহনীকে গড়ে তোলা বা বিভিন্ন খেলাধুলায় এদেশের ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে যুবকদের সম্পৃক্ত করায় একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে কামাল।
শেখ হাসিনা বলেন, বহুমুখি প্রতিভা নিয়ে সে জন্মছিল। হয়তো বেঁচে থাকলে আরও বেশি উন্নতি করতে পারত। সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড পেয়েছিল, যেহেতু সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্র, আমার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল সে যেন মাস্টার ডিগ্রিটা সম্পন্ন করে, সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। পরীক্ষাও দিয়েছিলো, পরীক্ষার রেজাল্টও পেয়েছি, রেজাল্ট পরে পেয়েছি। এটা হচ্ছে দুর্ভাগ্য রেজাল্ট সে দেখে যেতে পারেনি।
তিনি বলেন, ক্রীড়া জগত, সাংস্কৃতিক জগতে তার যে অবদান সেটা সকলের মনে থাকবে। সাথে সাথে আমি এটাও চাই আমাদের যে যুব সমাজ তারাও খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, সমাজসেবা এসব দিকে যেন আন্তরিক হয়, নিজেদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করে। সেটাই আমার আকাঙ্খা। সেজন্য আমরা যখনই ক্ষমতায় এসেছি তখনই আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের ক্রীড়া জগতটাকে আরও উন্নত করতে, সাংস্কৃতিক জগতটাকে আরও উন্নত করতে।
এমআই