মাহবুবুল হক খান, দিনাজপুর প্রতিনিধিঃ
দিনাজপুরে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ৫ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গোৎসবের সমাপ্তি হয়েছে। এর আগে শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ দিনে মঙ্গলবার জেলার প্রতিটি মন্ডপে মহানবমী ও বুধবার বিজয়া দশমী পূজা সম্পন্ন হয়। পূজার শেষ দিনে শহরের মন্ডপগুলো ঢাক-ঢোল, কাঁসর ঘণ্টা, শাঁখের ধ্বনি ও ধূপের ধোঁয়া, আর ভক্তিমন্ত্রে মূখর হয়ে ওঠে। সেই সাথে বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জায় উদ্ভাসিত হয়েছিল মন্ডপগুলো।
এই দিনেই দেবী দুর্গা মর্ত্যলোক (পৃথিবী) ছেড়ে ফিরে যাবেন স্বামীগৃহ কৈলাসে। দেবী দুর্গার বিদায়ে মন্ডপে মন্ডপে ছিল বিষাদের ছায়া। উলুধ্বনি, শঙ্খ, ঘণ্টা আর ঢাকঢোলের বাজনায় ছিল দেবীদুর্গার বিদায়ের সুর। গত ১ অক্টোবর মহাষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয় শারদীয় দুর্গাপূজা। আর ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় শারদীয় দুর্গাপূজার। সনাতন ধর্মাবলম্বি সম্প্রদায়ের লোকেরা গত ৫দিন হাসি-আনন্দ আর পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন।
বুধবার (৫ অক্টোবর-২০২২) বিকেল ৪টার পর বাসুনয়াপট্টি কেন্দ্রীয় মন্দিরসহ শহরের বিভিন্ন পুজামন্ডপ থেকে প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনের জন্য বিজয়া শোভাযাত্রা করে দিনাজপুর শহরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত পূর্ণভবা নদীর চাউলিয়াপট্টি সাধুরঘাট এলাকায় যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে একে একে নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। রাত ৮টায় প্রতিমা বিসর্জন দেয়া শেষ হয়। রাত ৮টার মধ্যে শহরের সবক’টি পূজা মন্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয় পূর্নভবা নদীতে।
এদিকে প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে শহরের মডার্ণ মোড়ে বিজয়া মঞ্চ তৈরী করা হয়ে। ওই মঞ্চ থেকে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি শারদীয়া শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এ সময় দিনাজপুর জেরা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জানকী, পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মর্তুজা আল মুঈদসহ অন্যান্য অতিথি উপস্থিত ছিলেন।
বিজয়া দশমীর অন্যতম আয়োজন ছিল দেবীবরণ। রীতি অনুযায়ী, সদবা নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় দশমীর দিন সিঁদুর, পান ও মিষ্টি নিয়ে দেবীদুর্গাকে সিঁদুর ছোঁয়ান। দেবীর পায়ে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর সেই সিঁদুর প্রথমে সিঁথিতে দিয়ে পরে একে অন্যের সিঁথি ও মুখে ছোয়ান। মুখ রঙিন করে হাসিমুখে দেবীদুর্গাকে বিদায় জানান, যা সিঁদুর খেলা নামে পরিচিত।
পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবীদূর্গা তার সন্তান কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীসহ মর্ত্যলোক (পৃথিবী) থেকে কৈলাসে স্বামীর গৃহে ফিরে যাবেন। এর আগে মহালয়ায় তিনি মর্ত্যলোকে (পৃথিবীতে) পিতৃ গৃহে আগমন করেন। আসুরিক শক্তির বিনাশ আর শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধি লাভের জন্য হিন্দু সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে দেবী দূর্গার আরাধনা করে আসছেন।
পঞ্জিকা অনুযায়ী, এবার দেবীদুর্গা মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) এসেছেন গজে (হাতিতে) চড়ে। শান্তি, সংহতি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আসুরিক শক্তির বিনাশকল্পে বিশ্বব্যাপী মঙ্গল বার্তা নিয়ে দেবীদুর্গা এ সময়ে লোকালয়ে আসেন। গজে চড়ে দেবীর আগমনের অর্থ হলো শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা। মনে করা হয়ে থাকে, দেবী যদি গজে চড়ে মর্ত্যলোকে আসেন তাহলে তিনি সঙ্গে করে সুখ, সমৃদ্ধি নিয়ে আসেন। হাতি হচ্ছে জ্ঞান ও সমৃদ্ধির প্রতীক। আর বিজয়া দশমীতে দেবী মর্ত্যলোক ছাড়বেন নৌকায় চড়ে। নৌকায় চড়ে মর্ত্য ছাড়লে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হবে। পৃথিবী হয়ে ওঠে শস্য শ্যামলা। কিন্তু সেই সঙ্গে অতি বর্ষণ বা প্লাবনের আশঙ্কাও দেখা দেবে।
অন্যান্য বারের ন্যায় এবারে দিনাজপুর শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত হিন্দু-মুসলিম নারী, পুরুষ, শিশু-কিশোর ছুটে আসে প্রতিমা বিসর্জন দেখতে। এ সময় শহরের মডার্ণ মোড় থেকে চাউলিয়াপট্টি সাধুরঘাট পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশ দর্শণার্থীদের পদচারনায় ভরে উঠে। ওই রাস্তার দু’পাশে অস্থায়ী দোকানীরা বিভিন্ন খাবারের দোকান, বাচ্চাদের খেলনাসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রীর দোকান সাজিয়ে বসেন। প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য দেখতে আসা দর্শণার্থীরা এসব খাবারসহ অন্যান্য সামগ্রী কিনে নিয়ে বাড়ী ফিরে যায়।
এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিমা বিসর্জনের সময় সার্বিক নিরাপত্তায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যবৃন্দ ও দিনাজপুর ফায়ার সার্ভিসের একটি দল প্রতিমা বিসর্জনের সময় সাধুরঘাট এলাকায় অবস্থান করেন।
অপরদিকে প্রতিমা বিসর্জনের সময় দিনাজপুর কোতয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) (তদন্ত) গোলাম মওলা, দিনাজপুর পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী আশরাফউজ্জামান বাবু, দিনাজপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার রায়সহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বিকেল ৪টা থেকে প্রতিমা বিসর্জনের শেষ সময় রাত ৮টা পর্যন্ত সাধুরঘাট এলাকায় অবস্থান করেন।
উল্লেখ্য, দিনাজপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের দেয়া তথ্যানুযায়ী এবারে জেলার ১৩টি উপজেলায় ১২৬৪টি মন্ডপে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৬৬টি (দিনাজপুর পৌরসভা এলাকার ৪৫টি মন্ডপসহ) মন্ডপে দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বীরগঞ্জ উপজেলায় ১৬০টি, কাহারোলে ৯২টি, বিরলে ৯৫টি, বোচাগঞ্জে ৮৪টি, চিরিরবন্দরে ১৫১টি, খানসামায় ১৩৪টি, ফুলবাড়ীতে ৫৯টি, বিরামপুরে ৪০টি, নবাবগঞ্জে ৬৯টি, হাকিমপুরে ২০টি ঘোড়াঘাটে ৪৪টি ও পার্বতীপুর উপজেলায় ১৫০টি মন্ডপে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
বুধবার ৫ অক্টোবর জেলার ১৩টি উপজেলায় ১২০৮টি মন্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয় ও ৫৬টি মন্ডপের প্রতিমা আগামী ৩দিনে বিসর্জন দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার রায়।
এমআই