আবু আলী ইবনে সিনা:
পর্ব-২
বিশ্ববিদ্যালয় মডেল নিয়ে প্রথম পর্বে কথা বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান বিতরণ নয় শুধু, জ্ঞান তৈরির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং সেই জন্য রিসার্চ ইনস্টিটিউট তৈরি করতে হবে এবং সেখানে বিশ্বমানের গবেষক নিয়োগ দিতে হবে|
এই পর্বে থাকছে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা এবং ফান্ডিং এর মডেল কি হওয়া উচিত সেটা নিয়ে আলোচনা
১. আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসা ভিত্তিক গবেষণার প্রতি বেশি উদ্যোগী হতে হবে|
আমাদের দেশে সবার মধ্যেই বিশেষ করে সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের ধারণা হলো গবেষণা হলো টাকা পানিতে ঢালা যেখান থেকে কোন ধরণের অর্থনৈতিক ফলাফল পাওয়া যায়না| এই কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা বিশেষ করে ব্যবসা ভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রে| আমেরিকা যে পৃথিবীর এক নম্বর দেশ হয়েছে সেটা এই ব্যবসা ভিত্তিক গবেষণা দিয়েই| আর এখন চায়নার দিকে তাকালে সেটা আরো বেশি বুঝতে পারা যায়| এই ব্যবসা ভিত্তিক গবেষণার জন্য দরকার সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের একই জায়গাতে মিলন| আপনার বাড়ির পাশের যে রেডিও, টিভি ও মোবাইলের মেকানিক সেও কিন্তু একজন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ| আপনার আমার চেয়ে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস এর কাজ সে অনেক ভালো জানে| অতএব আপনি যদি কোন একটা গবেষণার জন্য একটা ডিভাইস বানাতে চান সে হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবে| আবার একই ভাবে এই রকম জিঞ্জিরার কোন মেকানিক ও যাতে আপনার গবেষণা কেন্দ্রে এসে তার সমস্যার সমাধান পেতে পারে সেই পথ ও খোলা রাখতে পারে| এই বিষয়ে একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে| জিলেট নামটি সারা পৃথিবীতে পরিচিত এই নাম এর ব্লেড ও রেজরের কারণে| ঘটনাটি কিং ক্যাম্প জিলেট এবং তার দাঁড়ি কামানোর জিলেট ব্লেড এবং রেজর আবিস্কার সমন্ধে| কিং ক্যাম্প জিলেট আমেরিকার মেসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ব্রুকলাইন এ একজন সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন ১৮৯৬ সালের দিকে| কিন্তু বিক্রি করার চাইতে নতুন কোন কিছু তৈরী করার দিকেই তার ঝোঁক বেশি ছিলো| তাই সে তার বস উইলিয়াম পেইন্টার এর কাছে গিয়ে পরামর্শ চাইলো| উইলিয়াম পেইন্টার ডিসপোজেবল বোতলের মুখ আবিষ্কার করেন এবং এটা আমেরিকাতে খুব ব্যবসাসফল হয়| সে তাকে পরামর্শ দিলো এমন একটা কিছু তৈরী করো যেটা ডিসপোজেবল হবে এবং তোমার প্রোডাক্ট কাস্টমার এর বার বার কিনতে হবে| জিলেট একদিন দাঁড়ি কামাতে গিয়ে মোটা ব্লেড এর ক্ষুর দিয়ে তার গাল কেটে যায়| এই ধরণের ব্লেড নিরাপদ নয় কারণ এই ধরণের মোটা ব্লেড এর কাঁটা খুব গভীর হতো এবং সেই সময়ে এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার না হওয়ায় অনেকের মৃত্যুর কারণ হতো| তাছাড়া এই ধরণের ব্লেড বার বার ব্যবহারের কারণে একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে রোগ সংক্রমিত হতো| আবার এই ব্লেড খুব দ্রুত ভোঁতা হয়ে যেত এবং বার বার এটিকে ধার দেয়া লাগতো| ক্ষুর দিয়ে গাল কাঁটার পর তার মাথায় হঠাৎ করেই আইডিয়া এলো ডিসপোজেবল ব্লেড এর, যেটা নিরাপদ ও হবে এবং বার বার ধার ও দেয়া লাগবেনা| সাথে সাথেই সে এই ব্লেড তৈরির কাজে লেগে গেলো| যেহেতু তাঁর ব্লেড টি খুব অল্প দামের হতে হবে, তাই সে কাজ শুরু করলো সিট স্টিল দিয়ে যেটা সেই সময়ের একমাত্র সস্তা স্টিল ছিলো| কিন্তু সে কাজ করতে গিয়ে দেখলো এটা খুবই নরম যা দিয়ে খুব পাতলা এবং ধারালো ব্লেড বানানো সম্ভব নয়| সে বুঝতে পারলো তার এমন একজনের সাহায্য দরকার যার মেটাল সমন্ধে ভালো জ্ঞান আছে| তাই সে গেলো মেসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা এম এই টি এর স্টুন্ডেন্ট এবং ইঞ্জিনিয়ার দের কাছে| অনেকে আগ্রহ না দেখালেও উইলিয়াল নিকারসন নামের একজন এমআইটি গ্রেজুয়েট তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো| তাঁরা দুইজন মিলে অবশেষে তৈরি করলেন ডিসপোজেবল ব্লেড ও রেজর| জিলেট তার আবিষ্কার এর প্যাটেন্ট করলেন এবং জিলেট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন যেটি আজ সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত| এই ঘটনাটি একটি ব্যবসা ভিত্তিক গবেষণার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ| আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে এই রকম বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের ব্যবসা ভিত্তিক গবেষণার মিলনস্থলে পরিণত করতে হবে| একটি ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে সেটি হলো আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, আনন্দ, বিনোদন এবং দৈনন্দিন জীবন এ আমরা যা চাই সেই চাওয়ার উপর ভিত্তি করেই গবেষণা ও আবিষ্কার করতে হবে| আমাদের নিজেদের মার্কেট এ চলবে এই রকম প্রোডাক্ট | প্রথমেই চাঁদ ও মঙ্গল এ যাওয়ার মত বড় বড় আবিষ্কারের কথা চিন্তা করলে কিছুই হবেনা| আমেরিকা ও চায়না এই রকম ছোট ছোট প্রোডাক্ট দিয়েই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ এর পর এখন বড় বড় আবিষ্কারের পথে এগিয়েছে|
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আরেকটি শক্ত বন্ধন তৈরী করতে হবে ইন্ডাস্ট্রির| আমাদের অনেক সরকারি ও বেসরকারি ইন্ডাস্ট্রি আছে যারা কোন সমস্যায় পড়লে বিদেশ থেকে কনসালটেন্ট, বিজ্ঞানী বা ইন্জিনিয়ার নিয়ে আসেন| কিন্তু এই ধরণের সমস্যা সমাধানের কেন্দ্র করে তুলতে হবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ইনস্টিটিউট গুলোকে যেখানে আমাদের রিসার্চ একাডেমিকদের নেতৃত্বে, এমফিল, ও পিএইচডি স্টুডেন্টরা ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করবে|
আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোর আরেকটি দুর্বলতা হলো মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল এর সাথে তাদের খুব দুর্বল সংযোগ| আমাদের মেডিক্যাল কলেজগুলো শুধু নামেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কিন্তু সার্টিফিকেট নেয়া ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই| অথচ বিদেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মেডিক্যাল রিসার্চ ই সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং এর সাথে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল এর ডাক্তাররা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত| উদাহরণ হিসেবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল কিংবা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলম্বিয়া মেডিক্যাল স্কুল রয়েছে যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় অংশ| এই মেডিক্যাল স্কুল ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ডাক্তাররা কাজ করেন ও শিক্ষকতা করেন| সেই সাথে গবেষণার জন্য তারা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ইনস্টিটিউট গুলোতে গবেষণা করেন| যদি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর ডানা ফারবার ক্যান্সার ইনস্টিটিউট কিংবা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরভিং ক্যান্সার সেন্টার এর কথা উদাহরণ হিসেবে ধরি, এই ইনস্টিটিউট গুলোতে বেশিরভাগ গবেষকরাই ডাক্তার| তারা কেউ শুধুই গবেষণা অথবা কেউ কেউ গবেষণা হাসপাতালে কাজ ভাগ করে করেন| আর তারা যেহেতু রোগী নিয়ে কাজ করেন তাদের জন্য ব্যবসা ও সমস্যা ভিত্তিক গবেষণা করা আরো সহজ হয়ে যায়|
তার মানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণা ইনস্টিটিউট গুলো হলো জ্ঞান তৈরির মিলন মেলা যেখানে শিক্ষক, ডাক্তার, গবেষক, ইঞ্জিনিয়ার, ইন্ডাস্ট্রির লোক কিংবা মেকানিক সবাই একসাথে হয়ে জ্ঞান তৈরী করে| অথচ আমাদের মেডিক্যাল কলেজ এর ডাক্তারদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সংযোগ নেই এবং সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের গবেষণার কোন জায়গাও নেই|
২.বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য ফান্ডিং দেয়ার মডেল কি হতে পারে?
গবেষণার ফান্ডিংও হতে হবে বিশেষ করে বাংলাদেশের সমস্যা ও দেশের মানুষের চাহিদা ভিত্তিক গবেষণার উপরে| এতে করে ব্যবসা ভিত্তিক ও সমাধান ভিত্তিক গবেষক তৈরি হবে| বিদেশের বেশির ভাগ গবেষণা ফান্ডিং দেয়ার ক্ষেত্রে একটা কথার উত্তর উপর গুরুত্ব দেয়া হয় সেটা হলো এই গবেযণা দেশের কি কাজে লাগবে এবং কোন সমস্যার সমাধান করবে| এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের ফান্ডিং মডেল আছে যেটা নিয়ে বিস্তারিত আলাদা ভাবে লিখতে হবে| তবে তিনটি মডেল নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলতে চাই|
প্রথমটি হলো সরকারি মডেল| এই ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার মেডিক্যাল রিসার্চ ফিউচার ফান্ড বা এমআরএফএফ মডেল টি আমার খুব পছন্দ হয়েছে| সংক্ষেপে বললে এই ক্ষেত্রে সরকার আনুমানিক ১ বিলিয়ণ ডলার বা ১০ হাজার কোটি টাকা এর মত একটা থোক বরাদ্দ দিয়ে দিয়েছে যেটা ব্যাঙ্ক এ ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে দেয়া হয়েছে| প্রতি বছর এই টাকার উপর যে ইন্টারেস্ট আসে সেই টাকা গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়| এর ফলে সরকারকে প্রতি বছর গবেষণার জন্য বাজেট থেকে বরাদ্দ দিতে হয়না| বাংলাদেশ সরকার ও বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল গবেষনার জন্য আলাদা ফান্ড তৈরী করে এই মডেল ফলো করতে পারে|
দ্বিতীয় মডেলটি হলো ইন্ডাস্ট্রি থেকে ফান্ডিং| প্রতি বছর সরকারি ও বেসরকারি ইন্ডাস্ট্রি গুলো তাদের সমস্যা সমাধানের কিংবা নতুন কোন প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্ট এর জন্য ফান্ডিং দিবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ একাডেমিকরা সেই ফান্ডিং দিয়ে তাদের সমস্যা সমাধান কিংবা প্রোডাক্ট ডেভেলপ করে দিবে| এতে ইন্ডাস্ট্রির সুবিধা হলো এই গবেষণা র জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যবহার করে তারা অল্প পয়সায় তাদের সমস্যা সমাধান করতে পারবে| উন্নত দেশগুলোতে এই মডেলটির বেশ প্রচলন রয়েছে|
তৃতীয় মডেলটি হলো বিভিন্ন ট্রাস্ট/ চ্যারিটি সংগঠন থেকে ফান্ডিং | আমাদের দেশে অনেক ট্রাস্ট/ চ্যারিটি সংগঠন রয়েছে যাদের কাজ হলো গরিব মানুষদের অন্ন বস্র দিয়ে সাহায্য করা| এটা অবশ্যই ভালো কাজ কিন্তু এই কাজগুলো সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এর জন্য সহায়ক নয়| এই সংগঠন গুলোকে তাদের প্রয়োজন ও সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণা বরাদ্দ দিতে হবে সমাজের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এর জন্য|
এই তিনটি মডেল দিয়ে গবেষণা ফান্ডিং শুরু করলে আশা করি আমাদের দেশের গবেষকদের গবেষনা করার ফান্ডিং এর ও অভাব হবেনা এবং গবেষণা ও হবে ব্যবসা ও দেশের সমস্যা ভিত্তিক|
পরবর্তী পর্বে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মডেল এর আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি নিয়ে কথা বলবো| সাথেই থাকুন|