নিজস্ব প্রতিবেদক:
শেষ দিনে বই বিক্রির ধুম পড়েছিল বইমেলায়। মেলায় যারা এসেছেন তাদের অধিকাংশই বই কিনেছেন। লেখক-পাঠকের মিলনমেলা হয়ে উঠেছিল শেষ দিনের বইমেলা।
বাংলা একাডেমির হিসাবে বইমেলায় এবছর বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা। প্রকাশকরা বলছেন, গতবছর করোনার মধ্যেও বিক্রি এবারের তুলনায় বেশি ছিল। গত বছরের তুলনায় বিক্রি খুব একটা বাড়েনি। কোনো কোনো প্রকাশকের বিক্রি খুবই কম। যাদের বইয়ের আয়োজন বেশি ছিল তাদের বিক্রিও আশানরূপ নয়। বইমেলা নিয়ে লেখকরাও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তাদের মত, বইমেলাকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। প্রকাশকবান্ধব মেলা করতে গিয়ে এত এত প্রকাশকদের স্থান দেওয়া হয়েছে যে, মৌসুমি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ভিড়ে মানসম্পন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তাই, মেলায় ভুঁইফোড় প্রকাশনাগুলোকে স্থান না দিয়ে ভালো প্রকাশকদের নিয়েই বড় পরিসরে বইমেলা আয়োজন করার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক জানালেন, বই বিক্রি কম। করোনার আগে যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছিল এবার তার প্রায় অর্ধেক।
মেলায় এসেছিলেন কথাসাহিত্যিক, কবি আনিসুল হক। ছিলেন প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নে। তিনি বললেন, বইমেলা যে আশা জাগিয়ে শুরু হয়েছিল শেষ বেলায় এসে তা আর থাকেনি। বই বিক্রি আশানুরূপ হয়নি। তিনি বইমেলা স্টল বিন্যাসের জন্য স্থপতিদের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেন। পাশাপাশি বইমেলায় মৌসুমি প্রকাশকদের বাদ দিয়ে যারা ভালো ও মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করে তাদের নিয়ে গোছানো মেলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, বইমেলায় সরকারের কোনো অর্থসহায়তা দেওয়া হয় না বলে শুনেছি। এটা যদি সত্য হয়, তা খুবই দুঃখজনক। সরকারের এ খাতে বিনিয়োগ হওয়া উচিত। কারণ, জ্ঞানের ক্ষেত্রে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনিয়োগই শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। আমরা যে আদর্শের কথা বলি, তা টাকা খরচ করে সমাবেশ করে মানুষকে বললে হবে না। বই পড়লেই মানুষকে সেই আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হবে। সুতরাং বইয়ের প্রসারে বিনিয়োগ করতে হবে।
গতবছর মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই। করোনাকালের মধ্যে ২০২১ সালে মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৩ কোটি, ২০২০ সালে সাড়ে ৮২ কোটি, ২০১৯ সালে ৮০ কোটি, ২০১৮ সালের মেলায় বই বিক্রি হয়েছিল ৭০ কোটি টাকার। ২০১৭ সালে বিক্রি হয়েছিল ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০১৬ সালে ৪২ কোটি, ২০১৫ সালে বই বিক্রি হয়েছিল প্রায় ২২ কোটি টাকা।
গতকাল মেলার শেষ দিনে বই এসেছে ২৬৭টি। এবছর বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭৩০টি। তবে এ হিসাব বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়া বইয়ের। এর বাইরেও মেলায় নতুন বই প্রকাশ হয়েছে। এবছর, গতকাল মঙ্গলবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী দিনে বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এ বছর সর্বোচ্চ বই প্রকাশিত হয়েছে কবিতার। যা সংখ্যার হিসেবে ১ হাজার ২৪৭টি। এ ছাড়া এ বছর গল্প ৪৬৬, উপন্যাস ৫০৩টি, প্রবন্ধ ১৯৭টি, গবেষণা ৭৫, ছড়া ৮১, শিশুতোষ ৭৯টি, জীবনী ১২৮, রচনাবলি ৪৩, মুক্তিযুদ্ধ ৮০, নাটক ৫৪, বিজ্ঞান ৫১, ভ্রমণ ৬৭, ইতিহাস ৮৭, রাজনীতি ৩৩, স্বাস্থ্য ৩৩, রম্য ২২, ধর্মীয় ৫৫, অনুবাদ ৬৯, অভিধান ১৩, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ৬৭, বঙ্গবন্ধু বিষয়ক ৩৫ এবং বিবিধ বিষয়ে বই এসেছে ২৬৬টি।
বিকালে বইমেলার মূলমঞ্চে আয়োজিত সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বইমেলার সদস্য-সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলা একাডেমির সচিব এ এইচ এম লোকমান। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
কে এম খালিদ এমপি বলেন, আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে উদযাপিত এবারের বইমেলা সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে। বইমেলা কেবল বই বিক্রির জায়গা নয়। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনে বড় একটি দিগন্ত। বই পাঠের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে মানবিক দর্শন জাগ্রত হবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, কোভিড মহামারি পরবর্তীকালে এক মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ আয়োজন সত্যিই আমাদের জন্য বড় একটি সফলতা। বিন্যাস ও আঙ্গিকগত দিক দিয়ে এবারের বইমেলা সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ক্যারোলিন রাইট এবং জসিম মল্লিককে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২ এবং কবি মোহাম্মদ রফিক-কে কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়।
সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২২ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিকসংখ্যক বই প্রকাশের জন্য আগামী প্রকাশনী-কে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হয়। ২০২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে আহমদ রফিক রচিত বিচ্ছিন্ন ভাবনা প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুক্স, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ রচিত বাংলা একাডেমি আমার বাংলা একাডেমি বইয়ের জন্য ঐতিহ্য এবং হাবিবুর রহমান রচিত ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রকাশের জন্য পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়। ২০২২ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খি-কে রোকনুুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হয়। ২০২৩ সালের অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুথিনিলয় (প্যাভিলিয়ন), নবান্ন প্রকাশনী (২-৪ ইউনিট), উড়কি (১ ইউনিট)-কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়।
এমআই