মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশে কাসাভা চাষ, সুযোগ ও সম্ভাবনা

রোববার, মার্চ ৫, ২০২৩
বাংলাদেশে কাসাভা চাষ, সুযোগ ও সম্ভাবনা

মো. রাশেদুজ্জামান কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা :


কাসাভা নামটি বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত না হলেও দিন দিন এর পরিচিতি বাড়ছে। এই ফসলটি স্থানীয় ভাবে শিমুল আলু, কাঠ আলু, ঠেংগা আলু ইত্যাদি নামে পরিচিত। একটা সময় বানিজ্যিক ভাবে খুব বেশি চাষাবাদ ছিল না কাসাভার। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল সহ বিভিন্ন জেলায় স্বল্প পরিসরে এর আবাদ করা হত। কিন্তু বর্তমান সময়ে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে কাসাভার বাণিজ্যিক আবাদ শুরু করা হয়েছে। কুমিল্লা, পঞ্চগড়, চট্টগ্রাম, সিলেট সহ পাহাড়ি এলাকায় চাষ হচ্ছে কাসাভা।

 

কাসাভা বা শিমুল আলুর বৈজ্ঞানিক নাম ম্যানিহট এসকুলেন্টা( Manihot esculenta). এর অনন্য পুষ্টিগুণ এবং উপকারিতা রয়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের প্রায় পঞ্চাশ কোটি মানুষের খাবার এটি। অনেক দেশের প্রধান খাদ্য ও এই কাসাভা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সর্বপ্রথম মায়া সভ্যতার লোকজন কাসাভা চাষের সূচনা করেছিল। এই বিষয়ে মতভেদ থাকলেও দক্ষিণ আমেরিকায় এর চাষ শুরু হয় তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পরবর্তীতে পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতে আসে কাসাভা। উনিশ শতকের শেষের দিকে খ্রিস্টান মিশনারীদের হাত ধরে বাংলায় আসে এই উদ্ভিদটি। এটি মূলত কন্দাল শ্রেনীর উদ্ভিদ।

 

উচ্চশর্করা বা স্টার্চ সমৃদ্ধ এই ফসল চাষ করা অনেক সহজ। একটু উঁচু জমিতে কাসাভার চারা রোপণ করা যায়। এর বংশবিস্তার সাধারণত স্ট্যাম কাটিংয়ের মাধ্যমে করা হয়। চারা রোপণের ৬ মাস পর থেকে টিউবার সংগ্রহ করা যায়। কাসাভা চাষে খুব বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া গাছের রোগবালাই ও হয় না বললেই চলে। নিয়ম মেনে চাষাবাদের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি ২০-২৫ টন কাসাভা উৎপাদন সম্ভব।

 

বাংলাদেশে কাসাভার কয়েক ধরনের জাত চাষ করা হয়৷ তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় ফিলিপাইন থেকে আসা দুইটি জাত। সাধারণত আবাদের এক বছর পরেই ফলন পাওয়া যায়। মাত্র ৮/১০ বছর আগে দেশে কাসাভা চাষ শুরু হলেও দিন দিন ব্যপক জনপ্রিয় হচ্ছে এটি৷ বর্তমানে দেশে ০.০৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে ০.৪৬ লক্ষ টন কাসাভা উৎপাদন হয়। যা দেশীয় চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ। এক সময়ে অবহেলায় চাষ হওয়া ফসলটি বর্তমান বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল।

 

কাসাভার ঔষধি গুণ এবং পুষ্টিগুণ:

 

কাসাভার নানা রকম ঔষধি গুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। এটি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, হজমে সহায়তা করে, এমনকি ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। এতে কোলেস্টেরলের পরিমাণ শূণ্য। কাসাভা সব ধরনের হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়৷ এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বিদ্যমান যা হার্টকে ভালো রাখে৷ সেই সাথে হার্ট এট্যাক, স্ট্রোক সহ নানা রকম রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। কারণ কাসাভায় থাকা ফাইবার এলডিএলের মত খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে।

 

কাসাভা দেহের টিস্যু মেরামত ও রক্ষায় ভূমিকা রাখে। এতে রয়েছে লাইসিন, আইসোলিউসিন, ভ্যালিন এর মত প্রোটিন। নিয়মিত কাসাভা গ্রহণ আমাদের দেহের টিস্যু গুলোকে সুস্থ রাখে। সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু মেরামতেও অবদান রাখে।

 

এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম যা শরীরের হাড় ভালো রাখতে সহায়ক। সেই সাথে ভিটামিন কে এর উপস্থিতির কারণে অস্টিওপরোসিস, আলঝেইমার্সের মত রোগ প্রতিরোধে সক্ষম কাসাভা। নানা রকম সমীক্ষায় দেখা গেছে নিয়মিত কাসাভা গ্রহণে প্রবীণ বয়সেও দেহের হাড় মজবুত থাকে।

 

কাসাভায় রয়েছে পটাশিয়াম যা উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এতে হাইপারটেনশনের ঝুঁকি কমে।এছাড়া এটি ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে৷ যারা ডায়াবেটিস রোগী বা ভবিষ্যতে এই রোগ হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন তারা নিয়ম করে কাসাভা গ্রহণ করতে পারেন। এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বিভিন্ন ধরনের এন্টিঅক্সিডেন্টের উপস্থিতি ক্যান্সার প্রতিরোধও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।আলুর তুলনায় দ্বি গুনেরও বেশি পুষ্টি থাকে কাসাভায়৷ এর শর্করার প্রায় ৯০ শতাংশই উন্নত স্টার্চ হিসেবে থাকে।

 

কাসাভার ব্যবহার:

 

১. ওষুধ শিল্পে কাসাভার ব্যবহার

 

কাসাভার স্টার্চ ওষুধ তৈরির কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর থেকে পাওয়া স্টার্চ বেশ উন্নত মানের। দামে কম হওয়ায় বিপুল পরিমাণে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। কাসাভার স্টার্চ ট্যাবলেট, ক্যাপসুল এবং পাওডার জাতীয় ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। ট্যাবলেটের নির্দিষ্ট আকার দিতে, এর বিভিন্ন উপাদান গুলোকে এক সাথে মিশ্রিত করতে এই স্টার্চ ব্যবহৃত হয়।

 

আবার ক্ষেত্রে বিশেষে স্টার্চকে ফিলার ম্যাটেরিয়াল হিসেবে কাজে লাগানো হয়। বেশিরভাগ সময় মূল ওষুধের পরিমাণ এত সামান্য হয় যে তা থেকে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের আকার দেয়া সম্ভব হয় না। তখন ওষুধের সাথে স্টার্চ মিশ্রিত করে ক্যাপসুল বা ট্যাবলেটের আকার দেয়া হয়। 

 

এছাড়া কাসাভার স্টার্চ আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগে। ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল খাওয়ার পর এতে ব্যবহৃত স্টার্চ আদ্রতা শোষণ করে এবং আকারে স্ফীত হতে থাকে। যার ফলে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের সক্রিয় উপাদান গুলো ভেঙে বের হয়ে আসতে পারে।

 

২. অন্যান্য শিল্পে কাসাভার ব্যবহার

 

কাসাভাকে প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে আটা/ স্টার্চ পাওয়া যায়। এই আটা দিয়ে বিভিন্ন ধরণের খাবার তৈরী যায়। তাছাড়া এর থেকে তৈরি স্টার্চ ক্যামিকেল এবং গার্মেন্টসে কাপড় তৈরি সহ নানা শিল্পে ব্যবহার করা হয়। গার্মেন্টস শিল্পে কাপড়ে মাড় দিতে মূলত কাসাভার স্টার্চ ব্যবহৃত হয়।

 

এর থেকে প্রাপ্ত স্টার্চ কাগজ শিল্পে, বেকারী শিল্পে, ঔষধ শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে, জুস, জ্যাম-জেলি, গ্লুকোজ, অ্যালকোহল, আটা, গাম, তৈরীতে ব্যপকভাবে ব্যবহার হয়। এর স্টার্চ/আটা গমের আটার সংগে মিশিয়ে রুটি, পরাটা, কেক ইত্যাদি তৈরী করা যায়।সেই সাথে বার্লি, সুজি, রুটি, নুডলস, ক্র্যাকার্স, কেক, পাউরুটি, বিস্কুট, পাঁপড়, চিপসসহ নানাবিধ খাদ্য তৈরিতে এর ব্যবহার রয়েছে।

 

এছাড়াও কাসাভার মূল বা আলুর পিলেট, আটা মুরগি, গরু, মহিষ, ছাগল,  মাছ, ইত্যাদির জন্য একটি বিকল্প খাদ্য হতে পারে। প্রক্রিয়াজাত পাতা ও বাকি অংশ জৈব সার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া কাসাভা সরাসরি রান্না করেও খাওয়া হয়। অন্যান্য সবজি বা শুটকি, মাংসের সাথে একে রান্না করা যায়। কেউ কেউ এর টিউবার মিষ্টি আলুর মত পুড়িয়ে খান।

 

বাংলাদেশে চাহিদা অনুসারে উৎপাদন না থাকায় এতদিন এই স্টার্চ বাইরে থেকে আমদানি করতে হতো। দেশে ব্যপক হারে কাসাভা চাষ হলে এক সময় দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।

 

প্রতি কেজি কাসাভা থেকে প্রায় ৩৪০ গ্রাম পর্যন্ত স্টার্চ উৎপাদন করা সম্ভব। এক হেক্টর জমি থেকে বছরে প্রায় ২৫.৫ মেট্রিক টন অর্থাৎ ৩ হাজার ৪০০ কেজি কাসাভা আটা ও স্টার্চ পাওয়া সম্ভব।

 

 

কাসাভা চাষে সম্ভাবনা:

 

বাংলাদেশের শুষ্ক ও খড়াপ্রবণ অঞ্চল, টিলা, অনাবাদি পাহাড় সহ পতিত জমিতে কাসাভা চাষ করা যায়। অপেক্ষাকৃত কম উর্বর জমিতেও এটি চাষে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাই বাংলাদেশের মতো উচ্চ জনসংখ্যার দেশের জন্য কাসাভা আশীর্বাদ স্বরূপ। বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এটি সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল হয়ে উঠতে পারে। কচু, সরিষা সহ অন্যান্য ফসলের সাথে সাথী ফসল হিসেবেও এর চাষ হয়ে থাকে। ফলে বাড়তি জমির প্রয়োজনও পড়ে না।

 

বেসরকারি খাতে এর চাষে বিনিয়োগ করে চলেছে। সেই সাথে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সম্ভাবনাময় এলাকায় কাসাভা চাষে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চাষীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও চারা বিতরণ করা হচ্ছে।ওষুধ ও পোশাক শিল্পের জন্য প্রতি বছর প্রচুর স্টার্চের প্রয়োজন হয়। দেশের অনাবাদি জমি কাজে লাগিয়ে এই স্টার্চের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। পরিশেষে বলা যায়, ভবিষ্যতের খাদ্য সংকট মোকাবিলায় কাসাভা চাষ নতুন এক আশার দুয়ার খুলে দিতে চলেছে।



সময় জার্নাল/এসএম

 



Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল