নিজস্ব প্রতিবেদক:
মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকায় সাত চিকিৎসকসহ একটি চক্রের ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। চক্রটির অন্তত ৮০ সক্রিয় সদস্য প্রায় ১৭ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছে সিআইডি।
রোববার (১৩ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি হেডকোয়ার্টারের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া।
সিআইডি প্রধান বলেন, আগামী ১৭ আগস্ট থেকে শুরু হচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষা। সারা দেশের প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী এই পরীক্ষায় অংশ নেবেন। বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, পাবলিক পরীক্ষা এলেই এক শ্রেণির চক্র বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই চক্র নানা কায়দায় প্রশ্নফাঁস যেমন করে, তেমনি গুজব ছড়িয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্তও করে। শিক্ষাখাতের ক্যানসার হিসেবে বিবেচিত এসব প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রকে নির্মূল করতে নেতৃত্বস্থানীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
মোহাম্মদ আলী মিয়া আরও বলেন, দেশের সকল স্তরের প্রশ্নফাঁস বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে সিআইডির বিশেষায়িত একাধিক দল সারা বছর মাঠে কাজ করে ইতোমধ্যে এসএসসি, এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এবং বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসকারী সর্ববৃহৎ চক্রগুলোকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে নিয়মিত প্রশ্নফাঁসকারী বিশাল এক সিন্ডিকেটের খোঁজ পায় সিআইডির সাইবার পুলিশ।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় ২০২০ সালে হওয়া একটি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে একটি চক্রের সন্ধান মেলে। চক্রটির অন্তত ৮০ সক্রিয় সদস্য গত ১৭ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। এরপর অভিযান চালিয়ে সাত চিকিৎসক চক্রটির ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার করা চিকিৎসকদের মধ্যে চারজন বিএনপি এবং একজন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানান সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী।
তিনি আরও জানান, গত ৩০ জুলাই থেকে গত ৯ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল জেলায় অভিযান পরিচালনা করে এ চক্রটির ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় সিআইডির সাইবার টিম। গ্রেফতারকৃত ১২ জনের মধ্যে ৭ জনই ডাক্তার। এদের প্রায় সবাই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্নফাঁস করতেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৮ জন তাদের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। যাতে শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম উঠে এসেছে, যারা প্রশ্ন পেয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকে পাশ করে ডাক্তারও হয়ে গেছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এছাড়াও চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়রি উদ্ধার করা হয়, যেখানে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সেসব সদস্যদের ধরতে সিআইডির অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সিআইডি প্রধান জানান, তদন্তে উঠে এসেছে, ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করেছে। এদের ব্যাংক একাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো মানিলন্ডারিং মামলায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান (৫০) মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারে মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়ান। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে গত ২০ বছরে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। ডাক্তার ময়েজ প্রশ্নপত্র ফাঁস ও মানিলন্ডারিং দুটি মামলার এজাহারনামীয় আসামি। তিনি চিহ্নিত ছাত্রশিবির নেতা ও পরবর্তীতে জামাতের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত।
গ্রেফতারকৃত ডা. সোহেলী জামান (৪০) প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর চক্ষু ডাক্তার। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে স্বামী ডা. ময়েজের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের সাথে জড়ান। সেই কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন।
গ্রেফতারকৃত ডা. মো. আবু রায়হান ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়েন। প্রাইমেট কোচিং সেন্টার চালাতেন। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়গনেস্টিক সেন্টারে ডাক্তারি প্রাকটিস করেন।
গ্রেফতারকৃত ডা. জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮) মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম মূল হোতা। তিনি মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস মামলার এজাহারনামীয় আসামি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে থ্রি ডক্টরস নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত হন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে ডা. শোভন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। ডা. শোভন ২০১৫ সালে র্যাবের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছিল। ডা. জেএডএম সালহীন শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের পদধারী নেতা ছিলেন।
গ্রেফতার ডা. মো. জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮) মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রে জড়িত। নামকরা বিভিন্ন ডাক্তারের সন্তানদের চান্স পাইয়ে দিয়েছেন। মাস্টারমাইন্ড জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। এই ব্যবসা করে দামী গাড়ী, বাড়ি, ব্যাংকে নগদ অর্থসহ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। জোবাইদুর রহমান জনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক।
গ্রেফতারকৃত ডা. জিল্লুর হাসান রনি (৩৭) জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল (নিটোর) একজন ডাক্তার। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সাথে জড়িত হন। ২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় র্যাবের হাতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে রংপুর থেকে গ্রেফতার হন। রংপুর মেডিকেলে অধ্যয়নকালে ছাত্রদল নেতা ছিল। বর্তমানে ড্যাব এর সাথে জড়িত এবং আহত বিএনপি নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত টিমের একজন চিকিৎসক।
গ্রেফতারকৃত ডা. হিমেল পিতা আব্দুল কুদ্দুস সরকার এর মাধ্যমে এই চক্রের সাথে জড়ান। বেসরকারি কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলের আকুর টাকুর পাড়ায় নিজ শ্বশুর বাড়িতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পড়িয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে মেডিকেলে ভর্তি করান।
গ্রেফতারকৃত জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮) মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম এর বড় ভাই ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের মেশিনম্যান সালামের এর খালাতো ভাই। তিনি নিজে আলাদা একটি চক্র চালাতেন। বিজ্ঞ আদালতে ফৌঃকাঃবি আইনের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেছেন। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন।
গ্রেফতারকৃত রওশন আলী হিমু (৪৫) চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পুরনো সহযোগী। রওশন আলী হিমু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেফতারকৃত আক্তারুজ্জামান তুষার (৪৩) মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর। মেডিকেল প্রশ্নফাঁস মামলার এজাহারনামীয় আসামি। ই-হক নামে কোচিং সেন্টার চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। ২০১৫ সালে রাবের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছিল।
গ্রেফতারকৃত জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী (৪৫) মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা। মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের পুরানো সহচর। ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সাথে জড়িত। প্রাইমেট, থ্রি ডক্টরসসহ বিভিন্ন মেডিকেল কোচিং সেন্টারে ফাঁসকৃত প্রশ্ন সরবরাহ করতেন। রাজনৈতিকভাবে যুবদলের কর্মী। জহিরের পুরো পরিবার বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত।
গ্রেফতারকৃত আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩) টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন। মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের মাস্টারমাইন্ড জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার কলিকে ভর্তির মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান। এরপর ছেলে ইমরুল কায়েস হিমেলকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্নফাঁসের সুবিশাল এক সিন্ডিকেট। জসীমের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল কুদ্দুসের। জসীমও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিয়মিত টাঙ্গাইল আসতো।
এমআই