অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ:
বস্তির মানুষের জীবন-জীবিকা ও তাদের বেঁচে থাকা নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা হয়। গবেষণার কাজ ঢাকার অধিকাংশ ৰক্তিজুড়ে হয়। বস্তিবাসী ও নিম্নআয়ের বড় অংশের মানুষই ছিল গার্মেন্টস শ্রমিক। তাদের মধ্যে আবার অধিকাংশই হলো নারী শ্রমিক । এই বস্তির তালিকায় ঢাকার গুলশান, বনানী, মহাখালী, মগবাজার, আগারগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কমলাপুর, আদাবর, কামরাঙ্গীরচরসহ বিভিন্ন অঞ্চল। এ সকল বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই তাদের জীবনযাপন করতে হয়। তাদের শিশুরা বেড়ে ওঠে এক অসুস্থ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে। তারা যে সকল ঘরগুলোতে বসবাস করেন সেই ঘরগুলোর গড় ভাড়া ২৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত । অস্থায়ী বস্তি হওয়ার কারণে অধিকাংশ বস্তিতে তাদের বসবাস স্থায়ী নয়। যে কোন সময় সরকারি বুলডোজার, অগ্নিকান্ড (ইচ্ছেকৃত) তাদেরকে বাস্তুচ্যূত করে। তাদের সন্তানরা শিক্ষার ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রতি বছরই নানারকমের জ্বর, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড, ডায়েরিয়াসহ নানান মহামারিতে তারাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। সব থেকে প্রান্তিক অবস্থায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের বসবাস করতে হচ্ছে।
শ্রমিকদের ন্যূনতম বেঁচে থাকার মতো মজুরি ব্যবস্থা তৈরি হওয়া জরুরি। গত কয়েক বছরের মূল্যস্ফীতিতে জীবনযাত্রার যায় বেড়ে গেছে অনেক গুণ। আমরা জানি পৃথিবীর সকল পেশায় বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির একটি সুস্পষ্ট ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে তা অনুসরণ করা হয় না। যার কারণে প্রতিবারই মজুরি বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের আন্দোলন করতে হয়। আর এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয় পুরো সেক্টর জুড়ে। কিন্তু আমরা দেখি এই পরিস্থিতির জন্য কেবলমাত্র শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিকদেরকেই দায়ী করা হয়। সরকার ও মালিক পক্ষ থেকে। মজুরি কমিশনের মাধ্যমে বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়ানোর বিধান থাকলেও তা কার্যকর করা হয়নি।
গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য নিম্নতম মঞ্জুরি বোর্ড গঠিত হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসেবে, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য মূলত তিনটি মডেলকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর প্রথম মডেলটি হচ্ছে, দারিদ্র সীমার ওপরে অবস্থানকারী একজন শ্রমিকের মাসিক খরচের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা। দ্বিতীয় মডেলটি হলো, কাঙ্ক্ষিত পুষ্টি অর্জনের জন্য একজন মানুষের যে সুষম খাবার দরকার, তা বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা। তৃতীয় মডেলটি হলো, শ্রমিকদের বর্তমান জীবনধারণের খরচের হিসাব বিবেচনা করে তার ওপর ভিত্তি করে ন্যূনতম মঞ্জুরি ঠিক করা। সিপিডি বলেছে, দারিদ্র সীমার ওপরের স্তরে অবস্থানকারী প্রায় পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে 'জাতীয় খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার ব্যয় মাসে ৯ হাজার ২৮০ টাকা। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীকে এক্ষেত্রে আয় করতে হবে ৬ হাজার ৪৪৫ টাকা। সিপিডির হিসে পরবর্তী দু'টি মডেলে এই পরিমাণ আরও বাড়ে। কাি সৃষ্টিছারা অনুযায়ী খাবার গ্রহণ ও জীবনধারণের জন্য একজন শ্রমিকেরা প্রতি মাসে ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলকারী কিছু উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস বিশ্বব্যাপী এক অনন্য জায়গা দখল করে নিয়েছে। আর সে বিবেচনায় এই শিল্পের শ্রমিকদেরকেই এর অন্যতম কৃতিত্ব দিতে হবে। যদিও সাভারের রানা প্লাজায় ভবন ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের নির্মম মৃত্যু এবং তাজরীন ফ্যাশ- নসে দেশের স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা বাংলাদেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোকে শ্রমিকদের মৃত্যুকূপ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি দিয়েছে।
পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারসহ নানান সঙ্কটের মধ্যে আমাদের এই শিল্প আবতন করছে। সে বিবেচনা মাথায় নিয়ে সরকার, শ্রমিক ও মালিকপক্ষের উচিত একটি সুষ্ঠু সমাধানের পথ খুঁজে বের করা ।
শ্রমিক আন্দোলনে দর কষাকষি যেমন ন্যায্য, একইভাবে মালিকপক্ষের বক্তব্যও শুনতে হবে। এক্ষেত্রে সার্বজনীন উদাহরণগুলো ও আন্তর্জাতিক মানদত্ত মেনে মঞ্জুরি বৃ উদ্যোগ নেয়া জরুরি। একটি কথা সকল মহলেরই মানতে হবে এই শিল্প আমাদের সকলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল মালিকের মুনাফা তৈরির জায়গা নয়। গার্মেন্টস শিল্পকে এগিে নিতে হলে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির প্রশ্নটি কামানা করেই আমাদের এগুতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনোমিকস রিসার্চ (এনবিইআর)।