মো. জাহিদুল হক, চবি:
দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেলো ২০২৩। বিদায়ী পুরো বছরজুড়ে নানা ঘটনায় সংবাদের শিরোনাম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। দফায় দফায় ছাত্রলীগের উপগ্রুপগুলোর সংঘর্ষ, শাটল দুর্ঘটনা, ছাত্রীর আত্মহত্যা, যৌন হয়রানির শিকার, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, প্রক্টরসহ ১৯ জনের গণপদত্যাগ, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক, ভিসির পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষক সমিতির আন্দোলন, সাংবাদিক হেনস্তাসহ আলোচিত-বিতর্কিত নানা ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনায় ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়টি।
সারা বছরের আলোচিত কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলো পাঠকের জন্য।
দুই ছাত্রীর আত্মহত্যা: গত বছরের ৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে গলায় ফাঁস দেয়া এক ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ওই ছাত্রীর নাম রোকেয়া খাতুন। দেড় মাস পর ১৫ মে তেলাপোকার ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়। সুমি ত্রিপুরা নামের ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে নতুন রেজিস্ট্রার:
কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কাউকে পূর্ণকালীন রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের দাবিতে ১ জানুয়ারি আন্দোলন শুরু করেন চবি কর্মকর্তারা। আন্দোলনের মুখে পরের দিন চার দিনের ছুটিতে যান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান, তবে চার দিনের ছুটি শেষ হলেও অধ্যাপক মনিরুল আর রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেননি। এর মধ্যেই মনিরুল পদত্যাগপত্র জমা দেন। সর্বশেষ ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে এম নূর আহমদ।
প্রক্টরসহ ১৯ জনের পদত্যাগ: এ বছরের মার্চে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রশাসন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, প্রক্টরিয়াল টিমের একটি বড় অংশ, বিভিন্ন হলের প্রভোস্টসহ ১৯ জন একযোগে গণপদত্যাগ করেন। একসঙ্গে এতজনের পদত্যাগ চবিজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। প্রক্টরের পদত্যাগের ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানেই ওই দিন নতুন প্রক্টর নিয়োগ দেয়া হয়। নতুন প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ পান ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেসের অধ্যাপক ড. নূরুল আজিম সিকদার। নিয়োগের পর তাকে নিয়েও শুরু হয় বিতর্ক।
চারুকলা বিভাগকে ক্যাম্পাসের ফিরানোর দাবীতে আন্দোলন : শহর থেকে মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দাবিতে গত বছরের(২০২২) ২ নভেম্বর আন্দোলনে নামে চবি চারুকলার শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন পর্ষদের সমঝোতার চেষ্টাতেও তাদের ক্লাসে ফেরাতে সক্ষম হয়নি কেউ। আন্দোলনের মধ্যেই সিন্ডিকেট ডেকে চলতি বছরের(২০২৩) ২ ফেব্রুয়ারি সংস্কারকাজের জন্য চারুকলা ক্যাম্পাস ও হোস্টেল এক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপর আরও দুই দফায় বাড়ানো হয় চারুকলা বন্ধের মেয়াদ। সর্বশেষ স্থানান্তর আন্দোলনের ১৮২ দিন পরে ক্লাসে ফেরেন শিক্ষার্থীরা।
বিতর্কিত প্রার্থী নিয়োগ আটকে দেয় চবির সিন্ডিকেট : বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৪ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পালি বিভাগে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী অভি বড়ুয়াকে নিয়োগের সুপারিশ বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের সময় ওই প্রার্থীর বিরুদ্ধে তথ্য জালিয়াতির অভিযোগ তুলে পরিকল্পনা কমিটি।
বহিস্কৃত ছাত্রকে ক্ষমা ঘোষণা: সংঘর্ষ, ভাঙচুর, মারামারি, সাংবাদিক হেনস্তাসহ বিভিন্ন ঘটনায় গত বছরের ৯ জানুয়ারি ৯ নেতা-কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তবে আগস্টের শুরুতে তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে চিঠি পাঠানো হয়। প্রক্টর বলেন, ‘তারা নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আবেদন করেছে।’
শাটল দুর্ঘটনা; উত্তপ্ত ক্যাম্পাস: গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর শাটল ট্রেনের ছাদে চড়ে ক্যাম্পাসে ফেরার সময় হেলে পড়া গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ১৬ জন আহত হন। ঘটনার আকস্মিকতায় ফুঁসে উঠেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যেই ছড়ানো হয় শিক্ষার্থী মৃত্যুর গুজব।
মৃত্যুর গুজবে তাণ্ডব চালানো হয় চবির বিভিন্ন জায়গায়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আগুন জ্বালিয়ে ফটকে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে পুলিশ বক্সে ভাঙচুর চালান। রাত ১১টার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের ভাঙচুর করেন তারা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তর ও ক্যাম্পাস ক্লাবে গিয়ে ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ভাঙচুরের ঘটনায় দুইটি মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দুই মামলায় সাতজন করে ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও এক হাজার জনকে আসামি করা হয়।
সাংবাদিক হেনস্থা; দোষীদের মানবিক ক্ষমা ঘোষণা: গত বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন সাংবাদিককে হেনস্তা ও মারধর করা হয়। তারা হলে দৈনিক সমকালের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মারজান আক্তার, ঢাকা স্টেটের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি দোস্ত মোহাম্মদ ও দৈনিক প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মোশাররফ শাহ। সাংবাদিক হামলার ঘটনায় দফায় দফায় আন্দোলনে নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি। দোস্ত মোহাম্মদের ওপর হামলার ঘটনায় দুই ছাত্রলীগ নেতাকে ছয় মাস বহিষ্কার করা হলেও কয়েক মাস পরে মানবিক কারণে সেটি প্রত্যাহার করা হয়। অপর দুই সাংবাদিক হামলা ও হেনস্তার ঘটনায় এখনও বিচার হয়নি।
ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত: দফায় দফায় সংঘর্ষ ও সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এর আগে কমিটি ইস্যুতে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ায় শাখা ছাত্রলীগের একাধিক গ্রুপের সদস্যরা।
সংঘর্ষে ছাত্রলীগের উপগ্রুপ: তুচ্ছ ঘটনা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বছরজুড়ে বারবারে সংঘর্ষ ও সংঘাতে লিপ্ত হয়ে খবরের শিরোনাম হন শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপগুলো। এতে কমপক্ষে দেড় শতাধিক কর্মী আহত হন। এ ছাড়াও নানা ঘটনা ও দাবিতে অনেকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক ও হলে তালা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
ভিসির পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষক সমিতির আন্দোলন: আইন ও বাংলা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড বাতিলের দাবিতে গত ১৮ ডিসেম্বর ভিসির কাছে যায় চবি শিক্ষক সমিতি। তাদের অভিযোগ, শিক্ষক নিয়োগে বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের লঙ্ঘন, তবে ওই দিন দাবি না মানায় ভিসি ও প্রো-ভিসির পদত্যাগ দাবিতে টানা আন্দোলনের ঘোষণা দেয় শিক্ষক সমিতি। টানা তিন দিন অবস্থান কর্মসূচি শেষে চতুর্থ দিন প্রতীকী গণঅনশন করেন তারা। শীতের ছুটির পর পরবর্তী কর্মসূচি জানাবেন বলে জানিয়েছেন সমিতির নেতৃবৃন্দ। তবে এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে শিক্ষকদের আরেকাংশ।
এমআই