শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গু রোগের নামকরণ হয়েছিল যে বিচিত্র উপায়ে

বুধবার, জুলাই ১০, ২০২৪
ডেঙ্গু রোগের নামকরণ হয়েছিল যে বিচিত্র উপায়ে

সময় জার্নাল ডেস্ক:

ভাইরাসের নামকরণ সাধারণত যে প্রাণীর শরীরে তার উপস্থিতির কথা প্রথমবার জানা গিয়েছিল তার নামানুসারে রাখা হয়, কিংবা সেই জায়গায় যেখানে তা আবিষ্কার হয়েছিল। যে বিজ্ঞানী এই ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন, তার নাম অনুযায়ীও রাখা হতে পারে। কিন্তু সবক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি, যেমন ডেঙ্গু! এই ভাইরাসের নামকরণের নেপথ্যের কাহিনী বেশ রোমাঞ্চকর।

ষোড়শ শতকের শেষ দশকে, ডাক্তাররা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এক নতুন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা জানাতে শুরু করেছিলেন।

ফিলাডেলফিয়া, পুয়ের্তো রিকো, জাভা এবং কায়রোতে বহু মানুষ সে সময় একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। সবারই লক্ষণ ছিল এক- সর্বাঙ্গে তীব্র যন্ত্রণা এবং জ্বর, যাকে তারা ‘ব্রেক-বোন ফিভার’ (বা ল্যাটিন আমেরিকাতে কেবেরান্তা হুইসোস) বলে চিহ্নিত করেছিল।

তার বেশ কয়েক বছর পর, ১৮০১ সালে মাদ্রিদে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ায় তাতে আক্রান্ত হন তৎকালীন স্পেনের রানি মারিয়া লুইসা দে পারমা।

সুস্থ হয়ে ওঠার পর তার লেখা একটা চিঠিতে রানি ওই রোগের কয়েকটি লক্ষণ এবং নাম বর্ণনা করেছেন যা আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। রোগটা ছিল ডেঙ্গু।

২০২৪ সালে বিশ্বের ৯০টা দেশে এই ভাইরাস সক্রিয়ভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩১টা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সংখ্যক আক্রান্তের সংখ্যা নথিভুক্ত করা হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২৪ সালের জুন মাসে ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’- এর পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের বর্ধিত ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্কতা জারি করেছে।

কিন্তু ডেঙ্গুর নামকরণ কিভাবে হয়েছিল, সেই গল্পটা বেশ আকর্ষণীয় এবং ভাইরাসের নামকরণের পদ্ধতির বিষয়ে একটা ধারণা দেয়।

সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, মানুষের অন্ত্রে এক লাখ ৪০ হাজার ব্যাকটেরিওফাজের সন্ধান মিলেছে। এটা এক ধরনের ভাইরাস যা ব্যাকটেরিয়া কোষকে সংক্রামিত করে।

পরিচিত প্রজাতির মধ্যে প্রায় ২৭০টা ভাইরাস মানুষকে সংক্রামিত করে বলে এখনো পর্যন্ত জানা গেছে। নতুন রোগের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে সেই তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। তালিকায় জুড়েছে সার্স-কোভ-২, জিকা ভাইরাস এবং এমপক্স-এর মতো ভাইরাস, যা সংক্রমণ ব্যাধির সৃষ্টি করে।

ডেঙ্গু নামের সঠিক উৎপত্তি ঠিক কোথা থেকে তা কিছুটা অনিশ্চিত। তবে এর নামের সাথে রোগের লক্ষণের সাথে যোগ রয়েছে বলে মনে করা হয়।

ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা হাড় এবং পেশীতে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করেন যার ফলে নড়াচড়া করা কঠিন হয়ে যায়।

ডেঙ্গু নাম কিভাবে এলো, তার একটা তত্ত্ব হলো সোয়াহিলি শব্দের স্প্যানিশ সংস্করণ থেকে এই নামের উৎপত্তি। ‘কি ডেঙ্গা পেপো’ যার অর্থ হলো ‘অশুভ আত্মা দ্বারা হঠাৎই আক্রান্ত হওয়া’, সেখান থেকেই এসেছে এই নাম।

ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভারের (ভিএইচএফ) নামকরণের বিষয়টা বেশ উল্লেখযোগ্য। এর বেশ কিছু উপসর্গ আবার ডেঙ্গুর মতো।

আরো একটা মশাবাহিত রোগ আছে, যা ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভার গোত্রের অন্তর্গত এবং যকৃৎকে প্রভাবিত করে আর রোগীর দেহে জন্ডিসের সৃষ্টি করে। এই রোগ ‘ইয়োলো ফিভার’ নাম পরিচিত।


এই নাম কেন এসেছে, সে বিষয়ে আশ্চর্য হওয়ার অবশ্য কিছু নেই।

এর সূত্র ধরে আমাদের সামনে একটা নতুন সমস্যা এসে পড়ে আর সেটা হলো রোগের উপসর্গের ভিত্তিতে ভাইরাসের নামকরণ। কারণ বিভিন্ন রোগের উপসর্গ কিন্তু কাছাকাছি হতে পারে।

যকৃতের সংক্রমণের কারণে অনেকের জন্ডিস হতে পারে। এই রোগে চোখের সাদা অংশ, প্রস্রাব এবং মাঝে মাঝে ত্বকও হলুদ হয়ে যায়। উদাহরণ হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরার।

আবার এপস্টাইন-বার ভাইরাস, যা গ্রন্থিজনিত জ্বর সৃষ্টি করে তার নাম এসেছে আবিষ্কারক দুই বিজ্ঞানীর নাম থেকে- প্যাথলজিস্ট মাইকেল এপস্টাইন এবং ভাইরোলজিস্ট ইভন বার। এই রোগেও যকৃতের ক্ষতি হয়, জন্ডিস হতে পারে।

জার্মান হামের কারণ রুবেলা ভাইরাস। এর নাম এসেছে রোগের উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে। আক্রান্তদের শরীরে লাল ফুসকুড়ি দেখা দেয়। সেই লক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ‘লিটল রেড’ বা সামান্য লাল-এর ল্যাটিন সংস্করণ থেকে এসেছে ওই নাম।

তবে বিরল কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আক্রান্ত নবজাতকদের মধ্যে এই রোগে যকৃতের সমস্যা দেখা গেছে।

উপসর্গভিত্তিক ভাইরাসের মধ্যে রয়েছে চিকুনগুনিয়া। মশাবাহিত এই ভাইরাস জ্বর এবং গাঁটে গাঁটে গুরুতর ব্যথার সৃষ্টি করে।

পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়ায় এই রোগ প্রথম চিহ্নিত হয়। এই রোগে আক্রান্তদের তীব্র যন্ত্রণার কারণে বসা বা চলাচলের ভঙ্গি বদলে যায়।

স্থানীয় ভাষা কিমাকোন্ডে থেকে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘যা (যে রোগ) বাঁকিয়ে দেয়’। ভাইরাসের নামও সেই থেকে।

ও'নিয়ং'নিয়ং হলো আরো একটা সম্পর্কিত ভাইরাস যা আক্রান্তের শরীরে চিকুনগুনিয়ার মতোই লক্ষণের সৃষ্টি করে।

উপসর্গভিত্তিক এই ভাইরাসের নাম উত্তর উগান্ডার আচোলি উপভাষা থেকে এসেছে। অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অস্থিসন্ধির তীব্র বেদনাদায়ক দুর্বলতা’।

এরপর আসা যাক, সেই ভাইরাসের তালিকায়, যাদের নামকরণ করা হয়েছে সেই স্থানের অনুসরণে যেখানে এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল।

যেমন বলিভিয়ার হেমোরেজিক জ্বরের সাথে যুক্ত ভাইরাস, মাচুপো ভাইরাসের নাম এসেছে বলিভিয়ার সান জোয়াকিনে একটা নদীর নামানুসারে। ১৯৫৯ সালে ওই অঞ্চলে প্রথমবার এই ভাইরাস চিহ্নিত করা হয়েছিল।

কিন্তু কিছু ভাইরাসের নাম এসেছে দু’টি ভিন্ন জায়গা থেকে। এই দুই জায়গার মধ্যে হয়তো দূরত্ব হাজার হাজার মাইল।

১৯৬৭ সালের গোড়ার দিকে বিজ্ঞানী এবং ডাক্তারদের একটি দল বর্তমানের কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে কাজ করার সময় এই অঞ্চলে একটা রহস্যময় ভাইরাল হেমোরেজিক জ্বরের জন্য দায়ী ভাইরাসের কথা জানিয়েছিলেন। এই ভাইরাসের প্রকোপে ওই অঞ্চলে ১৯৫০ সাল থেকে দেখা যেত।

১৯৬৭ সালের পরের দিকে এক রাশিয়ান ভাইরোলজিস্ট একটা ভাইরাসের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ্যে আনেন যা টিক-বাহিত রক্তক্ষরণজনিত জ্বরের লক্ষণ সৃষ্টি করে। ১৯৪০ থেকে এই একই উপসর্গ দেখা যেত ক্রিমিয়া উপদ্বীপে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর মধ্যে।

কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার পর এই দুই ভাইরাসকে অভিন্ন বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। যে কারণে এর নাম হয় ক্রিমিয়ান-কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার।

২০২২ সালের প্রথমার্ধে ইরাকে এই ভাইরাসের সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ক্রিমিয়ান-কঙ্গো হেমোরেজিক জ্বরের ২১২টা ঘটনা নথিভুক্ত হয়। প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৭জন।

আশঙ্কা করা হয়েছিল যে এই রোগ নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে উত্তরে ইউরোপের কিছু অংশে যেমন ফ্রান্স, ইতালি, বলকান এবং স্পেনে।

আবিষ্কারের পর দেয়া ভাইরাসের নাম বিভ্রান্তিকর হতে পারে। এমপক্স এমন একটা রোগ যা কোনো প্রাণীর শরীর থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে- যা জুনোসিস নামে পরিচিত।

২০২২ সাল পর্যন্ত মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল এই ভাইরাস। নামটা কলঙ্ক ছড়াতে পারে, এই আশঙ্কা জানিয়ে পরে নাম পরিবর্তনের সুপারিশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

এই ভাইরাসের নাম আগে মাঙ্কিপক্স রাখার কারণ ছিল, এটা প্রথমে লক্ষ্য করা গিয়েছিল গবেষণার জন্য আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আমদানি করা বানরের মধ্যে।

কিন্তু বাঁদর এই ভাইরাসের ‘ন্যাচারাল হোস্ট’ বা প্রাকৃতিক ধারক নয়, বরং ‘অ্যাক্সিডেন্টাল হোস্ট’ বা ঘটনাচক্রে হওয়া ধারক।

মেরিল্যান্ডের ফোর্ট ডেট্রিকের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস ইন্টিগ্রেটেড রিসার্চ ফ্যাসিলিটির প্রধান ভাইরোলজিস্ট এবং ইবোলা ভাইরাসের বিশেষজ্ঞ জেন্স কুহন বলেছেন, ‘ভাইরাসগুলো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে চমৎকার।’

নতুন যে ভাইরাস আবিষ্কার হচ্ছে তার শ্রেণিবিন্যাসের দায়িত্বে থাকা আইসিটিভির উপকমিটির চেয়ারম্যানও তিনি।

জেন্স কুহন বলেন, ‘প্রতিটা নতুন ভাইরাস আবিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে এই কাজ আরো জটিল হয়ে উঠছে।’ একইসাথে বেশ কয়েকটা ভাইরাসের নতুনভাবে নামকরণও হয়েছে।

ইবোলার আনুষ্ঠানিক নাম আইসিটিভি রেখেছে ‘অর্থোইবোলাভাইরাস জাইরেন্সে’। আর ডেঙ্গু?

তার নামও পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০২২ সালে আইসিটিভি এর নামকরণও করেছে। ডেঙ্গুর নাম এখন অর্থোফ্লাভিভাইরাস ডেঙ্গুই, হয়তো বৈজ্ঞানিক দিক থেকে আরো সংগঠিত কিন্তু ততটা আকর্ষণীয় নয়!

এই নতুন নাম কিন্তু বেঁচে থাকলে স্পেনের সেই রানি (মারিয়া লুইসা দে পারমাকে) লেখার সময় হোঁচট খেতে বাধ্য করত, যার চিঠিতে ডেঙ্গু রোগের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল।

সময় জার্নাল/এলআর


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল