জেলা প্রতিনিধি, পঞ্চগড় :
নব্বইয়ের পর থেকে ছাত্র সংগঠনগুলোকে ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। যার ফলে ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে দূরে সরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্র সংগঠনগুলো। এ জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র রাজনীতির ভীতি তৈরি হয়েছে। এটিতে লাগাম টেনে ধরার জন্য ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা যৌক্তিক হয়েছে। ছাত্র সংগঠনকে ক্ষমতার সিঁড়ি বানালে কী পরিণতি হয়, তা রাজনৈতিক দলগুলোকে এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে– এমন মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তক শিশির আসাদ।
জনাব শিশির আসাদ একাধারে একজন রাষ্ট্র চিন্তক, লেখক ও দ্য ফিউচার বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। সম্প্রতি তিনি জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিয়েছেন। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে সময় জার্নাল প্রতিনিধি ।
সময় জার্নাল : বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি। আপনার মূল্যায়ন কী?
শিশির আসাদ : ছাত্র সংগঠনগুলো বাংলাদেশের জাতীয় সব আন্দোলনে একেবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ছাত্র রাজনীতি একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দেশের স্বার্থ কিংবা ছাত্র বা সমাজের স্বার্থ নিয়ে উন্মেষ হতো। বলা যায়, এটি একটি ক্রাইটেরিয়া ছিল। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাত্র রাজনীতি থেকে ডেভেলপ করেছে। ছাত্র রাজনীতির পরিধি ছিল জাতীয় স্বার্থে, মানুষের কল্যাণে, ছাত্রদের কল্যাণে। স্বাধীনতা স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল সময় ছিল।
সময় জার্নাল : ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাস বা সহিংসতা কীভাবে শুরু হলো?
শিশির আসাদ : নব্বইয়ের পরে যখন গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলো, দেশের মানুষের একটা বড় আশা ছিল– ছাত্র সংগঠন ছাত্র-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করবে। সেটির পরিবর্তে আমরা দেখি, ছাত্র রাজনীতি এক ধরনের ক্রিমিনালাইজ হয়েছে। ধীরে ধীরে ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের মূল সংগঠনের সঙ্গে একত্র হয়ে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হয়ে গেছে। এটি এক ধরনের গুণগত পরিবর্তন। দেখা গেল, যখনই যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করা হয়; ছাত্র সংগঠনেও লেজুড়বৃত্তি তৈরি হয়েছে। আবার মূল দল তাদের ব্যবহার করছে।
আমরা গত ১৬ বছরে দেখেছি, একদিকে আওয়ামী লীগ, আরেকদিকে ছাত্রলীগ; দুটোই পাল্লা দিয়ে সহিংসতায়– একই রকম সহিংসতায় জড়িয়েছে। যেহেতু ছাত্র সংগঠনের ওপর ডিপেন্ডেন্সি বেড়ে গেছে, ফলে নিজেরাই স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। একটা পর্যায়ে তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম অঙ্গীভূত সংগঠন বলা হয়েছে। ফলে এরা আরও স্বাধীন, আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে।
সময় জার্নাল : ছাত্র সংগঠনগুলোর এমন পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো?
শিশির আসাদ : ছাত্র সংগঠনের নেতারা গাড়ি কিনবে, ফ্ল্যাট কিনবে, প্রটোকল নেবে, বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করবে– এ প্রবণতা তাদের বেপরোয়া করে তুলেছে। অর্থ-ক্ষমতা বা লেজুড়বৃত্তি বা সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রবণতা দেখেছি। আবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মনে করে, টিকে থাকতে হলে সব পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ছাত্রলীগকে লাগবে। ফলে ছাত্রলীগের ওপর বা ছাত্র সংগঠনের ওপর এক ধরনের নির্ভরতা বেড়ে গেছে। ছাত্রলীগ যেমন নিজে চায়, সমাজের অন্য কাঠামোগুলোও তাদের চায়। গত ১৬ বছরে তাদের সংগঠন এভাবে এগিয়েছে।
সময় জার্নাল : আমাদের ছাত্র রাজনীতি কেন ভালো জায়গায় গেল না?
শিশির আসাদ : আমাদের এখানে নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা হয়নি। আমাদের বড় স্বপ্ন ছিল, একটা ভালো রাজনীতির পরিবেশ-গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে। তবে আমরা দেখলাম, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তাদের সাপোর্ট দরকার। যেহেতু ছাত্র সংগঠনগুলো বিগত সময়ে সাহসী ভূমিকা রেখেছে, তাদের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। গণতন্ত্রে জনগণের ওপর আস্থা-নির্ভরতা কমে ছাত্র সংগঠনের ওপর নির্ভরতা বেড়ে গেছে। তাদের ক্ষমতার অপরিহার্য মনে করা হয়েছে।
সময় জার্নাল : ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কীভাবে দেখেন?
শিশির আসাদ : যে ধরনের সহিংসতায় বাংলাদেশ যাচ্ছে, ছাত্র সংগঠনগুলো যাচ্ছে; তারা যদি বুঝতে না পারে, তারা অসীম পরাক্রমশালী জায়গায় পৌঁছে গেছে, তাহলে তাদের টেনে ধরতে হবে। এর থেকে তাদের ব্যান করে দেওয়া– সেটা হয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত দুই বছরে ১ হাজার ১১টি ঘটনায় আমরা দেখেছি, ছাত্রলীগ সরাসরি ৯০০ ঘটনায় জড়িত। এটি ৮৮ শতাংশ। ছাত্রদলের সম্পৃক্ততা ১০৪ ঘটনায় (১০ শতাংশ)। ছাত্রশিবির আটটি ঘটনায় জড়িত, যা ১ শতাংশের কম। অবশ্যই সহিংসতার মাত্রা যাদের ৮৮ শতাংশ, তাদের নিষিদ্ধের আওতায় আনা অযৌক্তিক নয়।
সময় জার্নাল : ছাত্র সংগঠনগুলোর এমন পরিস্থিতি কেন হয়েছে?
শিশির আসাদ : ক্ষমতায় থাকলে একটি প্যাট্রোনাইজেশন হয় তাদের মাদার সংগঠনের। ছাত্র সংগঠনগুলোর ডেটায় দেখেছি, ভায়োলেন্স করলে পুলিশ তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। ভায়োলেন্সের সক্ষমতার সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্র কানেক্টেড; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় রকমের সহায়তা করে।
সময় জার্নাল : নিষিদ্ধ করার পর আর কী কী করা যেতে পারে?
শিশির আসাদ : এখন বড় কাজটি করতে হবে, ছাত্র সংগঠনগুলোকে মাদার অর্গানাইজেশনের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে হবে। আমি ছাত্রলীগ করি, আমাদের মূল দল আওয়ামী লীগ। মূল দল থেকে ছাত্র সংগঠনগুলোকে সিগনিফিক্যান্টলি মিনিংফুলি আলাদা করতে হবে; শুধু অঙ্গীভূত বা ভ্রাতৃপ্রতিম– এসব বললে হবে না। সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে ছাত্র সংগঠনগুলোকে আলাদা করতে হবে। তাদের ছাত্রকেন্দ্রিক করে তৈরি করতে হবে।
সময় জার্নাল : ভবিষ্যতে কোনো সংগঠনের এমন পরিস্থিতি হতে পারে?
শিশির আসাদ: রাজনৈতিক দলগুলো শিখতে হবে, তারা যদি প্যাট্রোনাইজ করে তাতে কী পরিমাণ অনিষ্ট হতে পারে। আজকে শিক্ষার্থীরা বলছে, ছাত্র রাজনীতি থাকার দরকার নেই। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার ব্যাপক দাবি উঠেছে। কারণ এই ছাত্র সংগঠন বেপরোয়া হয়ে গেছে সহিংসতায়। এটা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর শিখতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র সংগঠনগুলো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। আমরা দেখতে পাই, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন; এটা তো ওভাবে পরিচিত ছিল না। তাহলে কী ধরনের অবস্থান তৈরি হলে অরাজনৈতিক একটি সংগঠন পুরো দায়িত্ব নিয়ে একটা ব্যাপক পরিবর্তন করতে পারে।
এটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য শিক্ষা, ভবিষ্যতে ছাত্র সংগঠন যদি রাষ্ট্রের মধ্যে চেপে বসে সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে কী হতে পারে– এটা বড় শিক্ষা। ছাত্রদের ভীতি তৈরি হয়েছে, ছাত্র রাজনীতি খারাপ জিনিস। তারা বছরের পর বছর দেখে তাদের অধিকার নিয়ে কিছু বলা হয় না।
সময় জার্নাল : ছাত্র রাজনীতি কি থাকা উচিত নাকি নয়?
শিশির আসাদ : রাজনীতি বা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যায় না। এটা একমাত্র সমাধান নয়। আগামী কোনো সংগঠন যেন এ রকম না হয়ে উঠতে পারে, এ জন্য রাজনৈতিক দল বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাবতে হবে ছাত্র সংগঠনের প্যাটার্ন কেমন হবে। মূল রাজনৈতিক দলের আঁচড় যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনে না পড়ে। তাদের ফিলোসফিক্যাল অ্যালাইনমেন্ট থাকতে পারে। মূল সংগঠন যেন নির্ভর করতে না পারে। তবে আমাদের সময় লাগবে, এটাকে ঠিক করতে হবে। সংস্কারের ফিলটা দিতে হবে।
তানহা আজমী