নিজস্ব প্রতিবেদক:
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে এবার সড়ক পথে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নিরাপদ, নির্বিঘ্ন করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নতুন এই সরকারের জন্য ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করা এক রকম চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থায় ঈদযাত্রা উপলক্ষে নতুন সেতু ও সড়ক খুলে দিয়েছে সরকার। যানজট নিরসন, যাত্রী নিরাপত্তা, টিকিটের অতিরিক্ত দাম ও কালোবাজারি বন্ধসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, এবারের ঈদযাত্রায় অন্যান্য বারের মতো যেন বিড়ম্বনা তৈরি না হয়, সে জন্য সারাদেশে একযোগে কাজ করবে বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশ। তিন হাজার ৯৯১ কিলোমিটার মহাসড়কে ১০১৮টি চেকপোস্ট ও টহলে থাকবেন হাইওয়ে পুলিশ ও বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা। ঈদ যাত্রাকে বছরের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হিসেবে দেখছে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
এদিকে ঈদ উপলক্ষে আগামী ২৫ মার্চ হতে ‘ঈদ স্পেশাল সার্ভিস’ চালু করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। ২০ মার্চ হতে বিআরটিসি’র ডিপো থেকে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে এবং আগামী ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ঈদ সার্ভিসের বাস চলাচল করবে। সঙ্গে বাস রিজার্ভের সুবিধাও রেখেছে বিআরটিসি।
শুধু তাই নয়, সরকারকে সহযোগিতার অংশ হিসেবে যাত্রীদের সেবা নির্বিঘ্ন করতে বেসরকারি অপারেটররা তাদের বহরে নতুন বাস সংযুক্ত করেছে। নির্ধারিত দামের অতিরিক্ত দামে টিকিট বিক্রি, যাত্রী হয়রানি ও বাসের শিডিউল বিপর্যয় রোধকল্পে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের পাশাপাশি মাঠে থাকবে বাস মালিক সমিতি। এদিকে কোনো কারণে বাসের শিডিউল বিপর্যয় হলে যাত্রীদের তাৎক্ষণিকভাবে তা জানাতে হেল্প সেন্টার চালু করেছে দেশের টিকিট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকম।
বাসসেবায় নতুনত্ব
বাংলাদেশে এসি ও নন এসি বাসের বাইরেও স্লিপার ও বিজনেস ক্লাস স্যুট বাস জনপ্রিয় হচ্ছে। এসব বাস আগে শুধুমাত্র ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে সেবা দিয়ে থাকলেও এবার দেশের অন্যান্য রুটেও সেবা দেবে।
অন্যতম দীর্ঘ মহাসড়ক ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটে এসি স্লিপার ও বিজনেস ক্লাস স্যুট সেবা প্রদান করবে। বুড়িমারী এক্সপ্রেস, হেরিটেজ ট্রাভেলস, শান্ত ট্রাভেলস, শাহ আলী পরিবহন তাদের বহরে এইসব বিলাসবহুল বাস যুক্ত করেছে।
দেশের দূরপাল্লার গণপরিবহন খাত জাপানিজ ব্র্যান্ড হিনোর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে দেশে তাদের একমাত্র পরিবেশক নতুন কোনো মডেল বাজারে আনতে না পারায় বাস মালিকরা মার্সিডিজ বেঞ্জের ওএফ ১৬২৩ মডেলকে হিনো বাসের সর্বোত্তম বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এতে করে দেশের নন-এসি বাসের যাত্রীরা দূরপাল্লার যাত্রায় এই ব্র্যান্ডের বাসকে বেছে নিচ্ছেন। দেশের সর্ববৃহৎ বাস কোম্পানি হানিফ এন্টারপ্রাইজও তাদের বহরে এই বাস যুক্ত করেছে এবার। এছাড়া দেশের বিভিন্ন সড়কে সেবাপ্রদানকারী বাস গুলোও তাদের বহরে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছে।
হানিফ পরিবহনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সিরাজুল ইসলাম রিকু বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা—বাসস’কে বলেছেন, আমরা আগের রুটগুলোতেই এবার সার্ভিস দিচ্ছি। তবে এবার আমরা বিভিন্ন রুটে ৬০টি নতুন বাস সংযুক্ত করেছি। এরমধ্যে ৪০টি উন্নতমানের মার্সেডিজ বেঞ্জের। আমরা কোনো রুটেই ঈদ উপলক্ষে ভাড়া বৃদ্ধি করছি না।
অনলাইনে টিকিট বিক্রির প্লাটফর্মে ব্যাপক সাড়া
কাউন্টারে অযথা ভিড় এড়াতে, আসা-যাওয়ার সময় বাঁচাতে, অতিরিক্ত দাম এড়ানোসহ নানা কারণে অনলাইনে টিকিটের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশে অনলাইনে টিকিট বিক্রির অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে বিডি টিকিটস, সহজযাত্রী, পরিবহন উল্লেখযোগ্য। এরমধ্যে সহজ ডটকম বাস, রেল ও লঞ্চের টিকিট সেবা প্রদান করছে। সহজ অনলাইন ও কাউন্টারে তাদের সফটওয়্যার দিয়ে ৩০ লাখ টিকিট বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।
বাসের টিকিট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার অপারেটর ও অনলাইনে টিকিট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমের টিকিটস ডিরেক্টর বলেন, আমরা এবার ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আমাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যাত্রীরা ১২০টি বাস অপারেটরের টিকিট বুকিং দিতে পারবেন। এছাড়া, আমাদের সফটওয়্যার ব্যবহার করে অনেক প্রতিষ্ঠান কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করছে। সব মিলিয়ে আমরা এই ঈদে ৩০ লাখ টিকিট বিক্রির প্রত্যাশা করছি। আমাদের সফটওয়্যারের মাধ্যমে অতিরিক্ত দামে কোনো অপারেটর টিকিট বিক্রি করতে পারছে না।
এছাড়া এবার যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে বাসের রিয়েল টাইম আপডেট ও হেল্প সেন্টার চালু করার কথা জানান সহজ ডটকম।
এবার যাত্রীসেবা ও সুরক্ষায় সজাগ বাস মালিক সমিতি:
বিগত বছরগুলোতে ঈদের সময় বাস মালিক সমিতির কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও ফিটনেসবিহীন বাস সড়কে চালাতো। এবার তা নিয়ে সোচ্চার খোদ বাস মালিক সমিতি। ইতোমধ্যে বাস মালিক সমিতি বাস মালিকদের সাথে সভা করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে না চালানোর জন্য একমত হয়েছে। তারা সড়কে ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল করলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে জানিয়েছেন। যাত্রী হয়রানি বন্ধ ও বাসের শিডিউল দেরি না করতে বাস মালিক সমিতির হেল্প ডেস্ক করার কথা জানিয়েছেন বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম।
তিনি বাসস’কে বলেন, এবার আমরা যাত্রীদের নিরাপদ ও সুন্দর ঈদযাত্রা উপহার দিতে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের প্রতিটা টার্মিনালে যাত্রীদের জন্য হেল্প ডেস্ক রাখব। কাউন্টারগুলোর সামনে নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা টাঙ্গানো থাকবে। যাত্রী হয়রানি করলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা থাকবেন। এছাড়া সকাল ও রাতে যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে টার্মিনাল এলাকায় পুলিশের টহল বাড়ানোর কথা জানিয়েছি।
নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্ন যাত্রায় বদ্ধপরিকর পুলিশ:
সড়কপথে ঈদযাত্রাকে নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে সারাদেশে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের হাইওয়ে ও ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। সারাদেশে তাদের কাজকে আরও গতিশীল করতে সড়ক-মহাসড়কে কাজ করবে জেলা পুলিশ, যা অন্যান্যবারের চেয়ে ব্যতিক্রম। আর ঈদে যাত্রী পরিবহনের সুবিধার্থে ঢাকার মূল সড়কগুলোয় ট্রাক চলাচল বন্ধ রাখবে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
সারাদেশের ৩ হাজার ৯৯১ কিলোমিটার মহাসড়কে নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে হাইওয়ে পুলিশ ৩৭৭টি চেকপোস্ট এবং জেলা পুলিশ ১১৪টি চেকপোস্ট ও ৫২৭টি টহল দল পরিচালনা করবে।
যানজট নিরসনে সারাদেশে ৬৪টি ‘ব্লাক স্পট’ চিহ্নিত করেছে হাইওয়ে পুলিশ। এসব এলাকায় পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য কাজ করবে। এছাড়া যেসব এলাকায় সংস্কার কাজ ও বাজারের জন্য যানজট লেগে যায়, সেসব এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে কাজ করা কথা জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। এর পাশাপাশি সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও যানচলাচল নির্বিঘ্ন করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
হাইওয়ে পুলিশ জানায়, সারাদেশের চেকপোস্টগুলো লাইভ ভিডিও’র মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। পুলিশের ৮টি রেঞ্জের ডিআইজিরা এসব চেকপোস্ট তদারকি করবেন। ইতোমধ্যে এলেঙ্গা, চট্টগ্রাম হাইওয়ে, মহিপাল ও নোয়াখালীসহ সড়কে ডাকাতির ঘটনায় অভিযুক্তদের ধরতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নাজমুল হাসান বলেন, ঢাকা থেকে যেন বাস সহজে বের হতে পারে সেজন্য আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। ঢাকায় প্রবেশ ও বহির্গমনে যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয় সেজন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। যাত্রী পরিবহনের সুবিধার্থে ঈদের তিন দিন আগে থেকে সড়কে ট্রাক-লরি চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে। প্রয়োজনে এক টনের পিকআপ ট্রাকগুলোর চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার মিঞা বাসস’কে বলেছেন, এবারের ঈদে আমরা যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাব। একইসাথে যানজট নিরসনে আমরা কাজ করছি। যাত্রীদের মধ্যে নিরাপত্তার কোনো শঙ্কা যেন না থাকে সেজন্য আমরা সারাদেশের মহাসড়কে টহল, চেকপোস্টসহ নিরাপত্তা জোরদার করছি। এবার সুন্দর ঈদ যাত্রা নিশ্চিত করার বিষয়ে আমরা আশাবাদী। সূত্র: বাসস।