নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের নানামুখী সংস্কার, জনগণের মৌলিক অর্থনৈতিক, নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে বৈষম্যহীন দেশ গড়া, দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু দেশের বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটেনি, রাজনীতির সংস্কার ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি ও বেকারত্ব তো রয়েছেই। সরকার গঠনের পর ১০ মাসে পেরিয়ে গেলেও টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে দেশে। তবে সুনির্দিষ্ট কোন সংস্কার দেখা যায়নি। দেশের মানুষের মাঝে স্বস্থি ফেরাতে দরকার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
আর এই দেশ গড়তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছেন জিওপলিটিক্যাল ইকোনমিস্ট অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ। 'বাংলাদেশে একটি জনবান্ধব সমাজ ও অর্থনীতি বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা' বইতে অধ্যাপক পারভেজ তথ্য নির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার রূপরেখা তুলে ধরেছেন।
আজকের লেখায় অধ্যাপক পারভেজের রুপরেখার তৃতীয় পর্ব-
অপরাধ দমন ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণ সাম্প্রতিক অপরাধ পরিসংখ্যান বাংলাদেশে উদ্বেগজনক বাস্তবতা প্রকাশ করে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত, ২২৪জন মেয়ে শিশুধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৮১জন নিহত হয়েছে এবং ১৩৩জন আত্মহত্যা করেছে। গত ১০বছরে (২০১৪-২০২৪) ১৮বছরের নিচের ৫,৬৩২মেয়ে শিশু ধর্ষণের মামলা রেকর্ড হয়েছে। ২০২৩সালে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ৫,১৯১টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, ২০২৪সালে ৪,৩৯৪টি মামলা হয়েছে। ২০২৩ জানুয়ারি থেকে ২০২৫ জানুয়ারির মধ্যে মোট ৯,৯৭৭টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, যা গড়ে প্রতিদিন ১৩জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়ার চিত্র তুলে ধরে। কিন্তু দুর্ভাগ্য জনকভাবে, এই মামলাগুলোর মাত্র ৩% দোষী সাব্যস্ত হয়। ব্র ্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯-২০১৪সালের মধ্যে তিনটি ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের মামলায় দÐের হার মাত্র ০.৮৬% ছিল ।এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি সহিংসতা আরও বাড়িয়ে দেয়। জনগণের নিরাপত্তা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, নীতিমালায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, সাক্ষী সুরক্ষা শক্তিশালীকরণ এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার আহবান জানানো হয়েছে। ছোট খাটো অপরাধে মোবাইলকোর্টের ব্যবহার বাড়িয়ে মামলার জট কমানো এবং তাৎক্ষণিক প্রতিকার নিশ্চিত করার প্রস্তাব রয়েছে। তবে এটি যেন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া বজায় রেখে পরিচালিত হয়, তা নিশ্চিত করার দিকেও বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর করলে "বিচার বিলম্বিত মানেই বিচার অস্বীকার" সমস্যার সমাধান হবে এবং জনগণের মধ্যে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বাড়বে।
জনগণের চাহিদার প্রতি বাজেট অগ্রাধিকার পুন:র্নির্দেশ বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে জনসম্পদ ব্যবহারে সামাজিক উন্নয়নখাত অবহেলিত থেকেছে। বাজেট বরাদ্দ নিয়ে নাগরিক অসন্তোষ ও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (এউচ) তুলনায় বরাদ্দ খুবই কম রয়েছে Ñ যেমন, ২০২৩সালে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় এউচ-র মাত্র-০.৭% এবংশিক্ষাখাতে-১.৬%। ফলে পরিবারের ওপর ব্যয়ের ভার চাপছে: স্বাস্থ্য খাতে ৭২% ব্যয় পরিবারগুলোকেই বহন করতে হয় Ñ যা বৈশ্বিকভাবে সর্বোচ্চহারগুলোর একটি। একইভাবে, শিক্ষা খরচেরও প্রায় ৭১% পরিবারগুলো বহন করে। অন্যদিকে, বড় অবকাঠামো প্রকল্পে বরাদ্দ উদারভাবে দেয়া হচ্ছে। এই প্রস্তাবনাগুলো জনগণের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজেট অগ্রাধিকার পুনর্গঠনের আহবান জানায়। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে এউচ-র ৫-৬% পরিমাণ ব্যয় বরাদ্দ করা (যেমন সমপর্যায়ের দেশগুলো করে) বহুদিনের অবহেলিত খাতের উন্নতি সাধন করবে। সরকারের নিজস্ব পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন বাজেটের ১১% এবং শিক্ষাখাতে ১৬.৫% বরাদ্দের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা বাস্তবে পূরণ হয়নি। বাজেটে মানব উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে যেমন স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ <১% থেকে বাড়িয়ে সুপারিশকৃত ৩%-এ পৌঁছানো, হাসপাতাল, স্কুল ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা সম্ভব হবে। জনমত ও পরিষ্কারভাবে এই পরিবর্তনের পক্ষে, কারণ মানুষ চায় এমন খাতে ব্যয় বাড়–ক, যা তাদের জীবন সরাসরি উন্নত করে (স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, কর্মসংস্থান), শুধু বিশাল মেগা প্রকল্পের পরিবর্তে (৩০)। এই বাজেট সংস্কার ও স্বচ্ছতার উদ্যোগে নিশ্চিত হবে যে, সম্পদ ন্যায্যভাবে সর্বাধিক প্রভাব ফেলে এমন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হবে।
নারী, যুবক এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তিসম্প্রসারণ
বাংলাদেশের একটি বড় অংশ এখনো আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে, বিশেষ করে নারী, তরুণ এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। ২০২১সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের মাত্র ৫৩% কোনো ব্যাংক বা মোবাইল মানি সেবা দাতা প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট খুলেছে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক জনগণ এখনো ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে। নারী-পুরুষের মধ্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ফাঁরাক এখনো লক্ষণীয় নারীদের অ্যাকাউন্ট মালিকানা পুরুষদের তুলনায় ১৯শতাংশ পয়েন্ট কম (৩৩)। (২০১৭সালে এই ব্যবধান ছিল ২৯%।) গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগণ ও নগদ অর্থ বা অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থারও পরনির্ভরশীল। এ কারণেই প্রস্তাবনাগুলো ব্যাংকিং অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর সুপারিশ করছে। সহজ অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়া, গ্রামে এজেন্ট ব্যাংকিং সম্প্রসারণ এবং লক্ষ্য ভিত্তিক আর্থিক পণ্য প্রবর্তনের মাধ্যমে আরও বেশি জনগণকে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে ২০২২সালে প্রায় ১৪.১% পরিবার নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছে, যা ২০১৬সালের তুলনায় দ্বিগুণ(৩৪)।
বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নারী ও তরুণদের ওপর: মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল ফাইন্যান্সের প্রসার তাদের চলাচল ও সাক্ষর তার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সাহায্য করছে। মোবাইল মানি সেবা বৃদ্ধির ফলে নারী-পুরুষের ফাঁরাক ২৯% থেকে ১৯%-এ নেমেছে (৩৩)। আর্থিক সাক্ষরতা কর্মসূচি এবং তরুণ-বান্ধব ব্যাংকিং (যেমন ছাত্র অ্যাকাউন্ট) চালু করে এই অন্তর্ভুক্তি আরও বাড়ানো সম্ভব। নারী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ, সঞ্চয় ও লেনদেনের সুযোগ তৈরি করে এই নীতিমালা সামগ্রিকভাবে ন্যায্য প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।
সময় জার্নাল/এমআই