নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঢাকা, ৫ অগাস্ট ২০২৪ সাল। অভ্যুত্থানের ক্যালেন্ডারে যেটা ৩৬ জুলাই। সেদিন সকাল শুরু হয়েছিল গুলির শব্দে!
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে হাজারো মানুষ ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে রওনা দিয়েছেন। উত্তরার দিকে ঢাকার প্রবেশমুখে তখন হাজারো মানুষ রাস্তায়।
হঠাৎ শোনা গেল উত্তরার বাধাগুলো ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনী। তখনো যাত্রাবাড়ীতে রীতিমত যুদ্ধ পরিস্থিতি। চানখারপুলে গুলি চালাচ্ছে পুলিশ। এর মধ্যেই এলো সেই খবরটি, ‘শেখ হাসিনা পালিয়েছেন’।
এরপর মুক্তির আনন্দে পথে পথে বাঁধভাঙা উল্লাস। কোথাও আবার নির্বিচারে ভাঙচুর, লুটপাট।
গণভবন, সংসদ ভবন আর ওই চত্বরে থাকা সরকারি বাংলোগুলোতে লাখো মানুষের ভিড়। ক্ষমতার চেয়ার উল্টে দেওয়ার আনন্দে শেখ হাসিনার বাড়িতে বসে সেলফি, আইনসভার বেঞ্চে বেঞ্চে বিদ্রোহের রাজ্যপাট।
আনন্দের সঙ্গে ক্ষোভের প্রকাশও ঘটল। থানায় থানায় চলল আক্রমণ, ভাঙচুর, লুটপাট; জ্বলল আগুন। ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্থাপনা যেমন পুড়ল, আক্রান্ত হল কিছু সরকারি স্থাপনাও।
ঢাকার উঁচু ভবন থেকে দেখা গেল, এদিক ওদিক নানা জায়গা থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠছে কালো ধোঁয়া। ফায়ার সার্ভিস সেখানে পৌঁছাতে পারল না।
হঠাৎ পুলিশশূন্য হয়ে পড়া দেশে রাতভর ডাকাত আতঙ্ক। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার অপেক্ষা।
সেই অপেক্ষার অবসান ঘটল ৮ অগাস্ট। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের আহ্বানে প্যারিস থেকে দেশে ফিরলেন নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বে দায়িত্ব নিল অন্তর্বর্তী সরকার।
এরপর শুরু হল আরেক অপেক্ষা। কবে হবে নির্বাচন? দাবি উঠল, ভোটের আগে হতে হবে বিচার আর সংস্কার। সে উদ্যোগ নেওয়া হল; ঘটনে অঘটনে, প্রত্যাশা আর হুতাশনে কেটে গেল এক বছর।
৫ অগাস্ট ২০২৫ সাল। প্রথম ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উদযাপন করছে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার সাধারণ ছুটি। বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া দিনটির স্মরণে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে নানা আয়োজন।
যে পথ ধরে ৩৬ জুলাই
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা ছিল। তবে এর হার ও ধরন বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে।
২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ পদে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত ছিল।
ওই বছর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করা হয়। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতই বহাল রেখে জারি করা পরিপত্র।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন।
গত ৫ জুন সেই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট।
ওইদিনই রায় প্রত্যাখান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখান শিক্ষার্থীরা। এরপর ৯ জুন হাই কোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫ জুন পরবর্তী ৬১ দিনের মধ্যে প্রথম ৪০ দিন দেশের নানা জায়গায় আন্দোলন হলেও জুলাইয়ের মাঝামাঝি মধ্য জুলাইয়ে ছাত্রদের লক্ষ্য করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলির মুখে এই আন্দোলনে যুক্ত হন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক, এমনকি চাকরিজীবীরা।
আন্দোলন রূপ নেয় এক দফায়– শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ।
সংঘাত আর রক্তপাতের মধ্যে জুলাই পেরিয়ে আন্দোলন প্রবেশ করে অগাস্টে। তবে আন্দোলনকারীরা বলে ওঠেন, তাদের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস শেষ হবে না। তারা গুনতে থাকেন ৩১ জুলাই, ৩২ জুলাই…।
হাজারো মৃত্যু আর রক্ত পেরিয়ে অবশেষে জুলাই মাস শেষ হয় ‘৩৬ দিনে’।
১৫ বছর ধরে বাংলদেশের শাসন ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা ৫ অগাস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। শুরু হয় শেখ হাসিনাবিহীন এক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা।
জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের যে তালিকা সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে, সেখানে শহীদের সংখ্যা ৮৩৪।
তবে অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘ যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ১৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হতে পারে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে।
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্ট বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি নিয়ে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যা ও নির্বিচার গুলির একাধিক বড় অভিযান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ও তদারকিতে হয়েছিল।
“সংগৃহীত সব তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং মুক্তভাবে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআরের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে যে সাবেক সরকার এবং এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয়ে সহিংস উপায়গুলো ব্যবহার করে পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িয়ে পড়ে। এ কারণে, শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বলপ্রয়োগ করা হয়। নির্বিচারে আটক, এবং নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের নিগ্রহের ঘটনা ঘটে।
“অধিকন্তু ওএইচএসিএইচআর যৌক্তিক কারণে মনে করে যে বিক্ষোভ এবং ভিন্নমত দমনের কৌশল হিসেবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের অবগতি, সমন্বয় এবং নির্দেশনায় পরিচালিত হয়েছে।”
এমআই