বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫

সাগরতীরে ঠকবাজি

কক্সবাজারের সী-প্রিন্সেস হোটেলে ২৩২ বিনিয়োগকারী প্রতারণার শিকার

বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৯, ২০২৫
কক্সবাজারের সী-প্রিন্সেস হোটেলে ২৩২ বিনিয়োগকারী প্রতারণার শিকার

গোলাম আজম খান, কক্সবাজার প্রতিবেদক:

সমুদ্রতীরে একখণ্ড স্বপ্নের ফ্ল্যাট বা স্যুট-এর মালিকানা এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্টে অবস্থিত অত্যাধুনিক আবাসিক প্রতিষ্ঠান হোটেল সী-প্রিন্সেসের ২৩২ জন বিনিয়োগকারীর জন্য। ডেভলপার প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার শিকার হয়ে শতকোটি টাকার এই প্রকল্পে বিনিয়োগকারীরা এখন অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছেন।

চুক্তি অনুযায়ী ২০১১ সালের মধ্যে ফ্ল্যাট/স্যুটের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করা হলেও তারা রেজিস্ট্রি পাননি। কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করেও মূলধন হারানোর পথে এই ভুক্তভোগীরা।

প্রতারণার জালে শতকোটি টাকার প্রকল্প
পর্যটন শহরের এই বহুল পরিচিত হোটেল সী-প্রিন্সেস প্রকল্পটি মূলত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হোম স্টোনের। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শহিদুল আলম ও চেয়ারম্যান ডালিয়া আলমের বিস্তৃত প্রতারণার জালে আটকে আছে শত কোটি টাকার এই প্রকল্প। প্রতিকার চেয়ে ভুক্তভোগীরা আদালত ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একাধিক মামলা করেছেন। অভিযুক্ত শহিদুল আলম ও তার স্ত্রী ডালিয়া আলম ঢাকার ওয়ারি থানার বাসিন্দা।

সংবাদ সম্মেলনে উঠে এলো ভয়াবহ চিত্র
গত ৭ অক্টোবর হোটেল সী-প্রিন্সেসের বিনিয়োগকারীরা সংবাদ সম্মেলন ডেকে তাদের দুর্ভোগের বিস্তারিত তুলে ধরেন। দি সী-প্রিন্সেস হোটেল প্রকল্পের স্যুট মালিকদের পক্ষে সফিউল আজম, ইঞ্জিনিয়ার এনামুল কবির, প্রফেসর ডঃ মুনিরা ইয়াসমিন, ড. অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, ফরিদুল হাসান চৌধুরী, শফিকুল আজম সিদ্দিকী, সাঈদ ওসমান, মাকসুদুর রহমান স্বপন, কুতুব উদ্দিনসহ প্রায় ১০০ জন বিনিয়োগকারী নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেন।

সংবাদ সম্মেলনে সফিউল আজম জানান, স্যুট/ফ্ল্যাট বিক্রি বাবদ হোম স্টোনের এমডি মো. শহিদুল আলম তাদের কাছ থেকে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা নিয়েছেন।

বন্ধক ও বিদেশে অর্থপাচার
বিনিয়োগকারীদের সম্পূর্ণ অগোচরে ও প্রতারণার মাধ্যমে ডেভেলপার হোটেলটি বন্ধক রেখে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ কোটি টাকা ঋণ নেন। সুদে-আসলে বর্তমানে যার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করেই শহিদুল আলম সপরিবারে ২০১৫ সালে বিদেশ পাড়ি জমান। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, তিনি মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন।

তিনি নিজের আজ্ঞাবহ লোক দিয়ে হোটেল পরিচালনার মাধ্যমে শতকোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও দাবি করেন ভুক্তভোগীরা। এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে তিনি তৎকালীন পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানকেও ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়।

সী-প্রিন্সেসের ২৩২ জন ক্রেতা তাদের সঞ্চিত বা পেনশনের টাকা বিনিয়োগ করে আজ পথে বসার উপক্রম। অনেকেই ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

বিচারাধীন মামলা ও আদালতের নির্দেশ
প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন আদালতে মামলা দায়ের করেছেন:

৮৩ জন ফ্ল্যাট মালিক কক্সবাজার অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা করেছেন, যার নং: ০৪/২০১৬ (ঢাকা)। মিচ মামলা নং-৪৩/২০২৪। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।

৩৯ জন ফ্ল্যাট মালিক রিয়েল এস্টেট আইনে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং-৪ এ পৃথক আরও একটি মামলা করেন।

আদালত কর্তৃপক্ষ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন যে ঋণের টাকা আদায় করতে তারা এককভাবে হোটেল বিক্রি করতে পারবে না, বরং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বসে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাংক ও ডেভলপারের বিরুদ্ধে
বিনিয়োগকারীরা জানান, হোটেলটি নির্মাণে সর্বোচ্চ ৪০ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা থাকলেও তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৫৬ কোটি টাকা। এর বাইরে ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে আরও ৩০ কোটি টাকা ঋণ।

বিনিয়োগকারীরা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ঋণ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। এই কারণে ব্যাংক এবং ২৩২ জন ব্যক্তির বিনিয়োগ এখন ঝুঁকিতে। ভুক্তভোগীরা অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা ও প্রতারক শহিদুল আলম গংয়ের দুর্নীতির অনুসন্ধান করে কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন।

অসমাপ্ত কাজ ও ওয়ারিশদের তৎপরতা
সরেজমিনে দেখা যায়, ১১ তলা ভবনের মধ্যে কমন সার্ভিসের প্রথম ও দ্বিতীয় তলাসহ হোটেল স্যুটের জন্য কেবল তৃতীয় ও চতুর্থ তলা নির্মাণ করে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান হোটেল উদ্বোধন দেখিয়ে ফ্ল্যাট মালিকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। মোট ২৪২ কক্ষের অর্ধেক এখনো প্রস্তুত হয়নি। অথচ ১১ তলা ভবনের পুরো টাকা আত্মসাৎ করেছেন শহিদুল আলম।

ভুক্তভোগী কুতুব উদ্দিন জানিয়েছেন, প্রতারক শহিদুল আলম ফ্ল্যাটের মালিকদের রেজিস্ট্রি না দিলেও মালিকানা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস তাদের হাতে রয়েছে।

বিনিয়োগকারীরা আরও জানান, প্রবাসে পলাতক শহিদুল আলম সম্প্রতি মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর ওয়ারিশগণ নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে হোটেলটি বিক্রি করে দিতে তৎপর হয়েছেন।

বিনিয়োগকারীদের ৫ দফা দাবি
আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের প্রতি আস্থা রেখে ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা ৫টি দাবি তুলে ধরেছেন:

১. হোটেলটি বিক্রয়, হস্তান্তর বা কোনো প্রকার দখল পরিবর্তনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ।
২. ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া, রেজিস্ট্রি অফিসের অনুমোদন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা।
৩. প্রকৃত ক্রেতা ও মালিকদের সঙ্গে বসে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা।
৪. ফ্ল্যাট/স্যুট মালিকদের বৈধতার স্বীকৃতি এবং সম্পত্তি বিক্রির উদ্যোগ না নিতে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের প্রতি আহ্বান।
৫. শতশত বিনিয়োগকারীকে বাঁচাতে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা।

নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন ও সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। একই সঙ্গে যৌক্তিক দাবি আদায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন তারা।

একে 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল