এম. জুবায়ের হোসেন: ড. হোসনে আরা বেগমের জীবনের প্রতিটি ঘটনাই ব্যতিক্রম-ধর্মী। সমাজকর্মী, অধ্যাপক, উন্নয়নকর্মী ও উদ্যোক্তা ইত্যাদি সৃজনশীল বিশেষণ ত্াঁর নামের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ছোট বেলা থেকেই ছিলেন ছাত্র হিসেবে মেধাবী। তিনি স্বপ্নবাজ ও সংগ্রামী নারী হিসেবে সুপরিচিত। তিনি স্বপ্ন দেখে ও দেখিয়ে নারী উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন দেশ-বিদেশে। শুধু নারী উন্নয়ন আর দারিদ্র্য বিমোচনই নয়, তার বিরল অভিজ্ঞতা রয়েছে পুরুষ আর নারী উভয় জীবনেরই। জন্মে ছিলেন পুরুষ হয়ে বর্তমানে তিনি একজন সফল নারী এবং বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও ‘টিএমএসএস’ এর সফল নির্বাহী পরিচালক।
বগুড়ায় ১৯৫৩ সালে বাবা সোলায়মান আলী ও মা জোবাইদা বেগমের ঘর আলোকিত করে দুনিয়ায় আসেন আব্দুস সামাদ। নিজ জেলা বগুড়া থেকেই তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়া শেষ করেন। তেইশ বছর বয়সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানি বিভাগে পড়ার সময় পেটে টিউমারের সূত্র ধরে ছেলে আবদুস সামাদ থেকে মেয়ে হোসনে আরা বেগম হওয়ার পরিবর্তন ঘটে। মেয়ে হওয়ার পরই তিনি বুঝতে পারেন নারী জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে লাঞ্চনা-বঞ্চনা, নিরাপত্তাহীনতা ও অধিকারহীনতার কথা। সেই সূত্র ধরেই ১৯৮০ সালে তিনি বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পাশে ৫০০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন ‘টিএমএসএস’ বা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ যা পূর্বে ‘টিএসএস’ নামে ছিল।
এ সংঘের পক্ষ থেকে ‘পরিবারই হোক নারীর উন্নয়নের কেন্দ্রস্থল’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১২৬ জন ফকিরের ২০৬ মণ মুষ্ঠিবদ্ধ চাউল নিয়ে তিনি নারী উন্নয়নের স¦প্ন ও সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। খিচুরি খাইয়ে তিনি ফকিরদেরকে একসাথে করে তাদের উন্নয়ন আর ভালভাবে বেচেঁ থাকার স্বপ্ন তাদের মনে বুনে দিতেন। নিজের ও তার সদস্যদের স্বপ্ন,ইচ্ছা, উদ্যোগ ও সংগ্রাম সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এই ফকিরদের মুষ্ঠিবদ্ধ চাউল থেকে আজকের টিএমএসএস প্রায় ২৫০০০ হাজার কোটি টাকার মালিক। জয় করেছেন দারিদ্রতাকে। সৃষ্টি করেছেন সারা দেশে হাজার-হাজর মানুষের জন্য কর্মসংস্থান। আত্মমর্যাদা নিয়ে সমাজে বাস করার মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন নারীদেরকে। বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় এর কার্যক্রম এবং ৮৮টি প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি কর্মরত আছে প্রায় ৩৫০০০ নারী। বর্তমানে সারা দেশে ছোট-বড় ১ লক্ষ ১২ হাজার সমিতি রয়েছে ‘টিএমএসএস’ আওতায়। তাছাড়াও নিজস্ব মালিকানায় রয়েছে মেডিকেল কলেজ, নাসিংকলেজ, ডিপ্লোমা মেডিকেল কলেজ, পলিটেকনিকেল ইন্সসটিটিউট, টে´টাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ট্রাভেল এন্ড টুরিজম, গরীব রোগীদের জন্য রয়েছে চিকিৎসা সেবা হাসপাতাল, সিএনজি স্টেশন, বগুড়ায় পাঁচতারকা হোটেল ও ক´সবাজারে রিসোর্টসহ নিজস্ব হেলিকপ্টারও রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬৪ জেলায় প্রায় ৫৩ লক্ষ পরিবারকে এ প্রতিষ্ঠান সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তার ইচ্ছা আমৃত্যু দারিদ্র্য বিমোচন, নারী উন্নয়ন, গরীব-দুঃখী ও বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে যাবেন। বন্যা, করোনাসহ সকল ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তিনি গরীব-দুঃখী ও মেহনতী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি মনে করেন-‘‘দেশকে উন্নত করতে হলে নারী জাতিকে সমস্ত বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। নারীর উন্নয়ন না হলে দেশের উন্নয়ন অর্ধেক বাকী থেকে যাবে।’’
হোসনে আরা বেগমের সৃজনশীলতা ও কর্ম দক্ষতা ৮ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থাতেই ধরা পড়ে। ঐ সময়ে তিনি বালক থাকা অবস্থায় কৃষি ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য গঠন করেন ‘বয়েজ ক্লাব’। ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে জমি চাষাবাদ করতেন। হালচাষ করার জন্য গরু না পাওয়া গেলে নিজেরাই নেমে পড়তেন কোঁদাল নিয়ে। ছোটকাল থেকেই সামাজিক কর্মকান্ডে তিনি জড়িত ছিলেন। পরবর্তিতে বড় হয়ে তিনি ‘টিএমএসএস’ গঠনের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া হাজার হাজার নারীদেরকে প্রশিক্ষন দিয়ে চাকরি দিয়েছেন তিনি। উদ্যোক্তা হতে চাইলে তিনি ‘টিএমএসএ’ থেকে ২০ লক্ষ টাকা পযর্ন্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করেন। স্বপ্ন ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বগুড়াসহ সারা দেশে সুখী পরিবার গঠনের স্বপ্ন দেখছে ও কাজ করে যাচ্ছে তার সংগঠনের লোকেরা। দারিদ্রতা, নারী উন্নয়ন, রোগ-ব্যধি সচেতনা, নিরক্ষরতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তার মূল সংগ্রাম। তিনি বিশেষ করে কাজ করে যাচ্ছেন নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য। দেশের উন্নয়নের জন্য তার একটি বিশেষ গুণ- তিনি নিয়মিত ধার্যকৃত কর ও ভ্যাট প্রদান করেন সরকারকে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন, ডিএফআইডি, নেদারল্যান্ড সরকার ও আমেরিকাসহ অনেক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা তার ‘ টিএমএসএস’কে আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। তিনি মানুষকে অনেক ভালোবাসেন। দল-বল,ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য তার এক অসীম হৃদয় রয়েছে। এই মহিয়সী নারীর এক বিশেষ দুর্বলতার নাম নারী। কথিত আছে- কোন নারীই তাঁর কাছে চাকরীর চেয়ে খালিহাতে ফেরত যাননি এবং এক সময় যাদের কিছুই ছিলোনা, তারাও তার পথে হেঁটে এখন খেয়ে-পড়ে অনেক ভালো আছেন। তার স্বপ্ন আরো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বঙ্গনারীর অধিকার ও আত্মমর্যাদা নিশ্চিত করার। ইতিমধ্যেই তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠান অশোকা ফেলোশীপ ও বেগম রোকেয়া পদকসহ দেশী-বিদেশী অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সরকার ও সুশীল সমাজের সহায়তা পেলে বড় আন্তর্জাতিক পুরস্কারও তিনি পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। আজকের এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই সৃষ্টিশীল নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও নারী জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার প্রতি আন্তরিক ।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।
সময় জার্নাল/আরইউ