মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বিজ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে আসলে পালানোর জায়গা নেই

শুক্রবার, আগস্ট ৬, ২০২১
বিজ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে আসলে পালানোর জায়গা নেই

ডা. আব্দুর রব :

উপজেলায় গিয়ে জীবনের প্রথম যে রুগীটা দেখেছিলাম তিনি ছিলেন আমার চাচাত ভাইয়ের বেয়াই। সম্পর্কে আসলে আমারও বেয়াই। স্ট্রোকের রুগী, শরীরের একপাশ প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। বুঝেশুনে মনে হল Ischaemic Stroke, সাথে প্রেসার অনেক বেশি । সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়েছিলাম। বাসায় বসে ওষুধ খেত আর মাঝে মাঝে ভ্যানে করে আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যেত। দুই-তিন মাস পরে দেখি সে লাঠি ভর দিয়ে হাটতে পারে। আরো পরে দেখি সে কোন সমস্যা ছাড়াই চলাচল করে। তারও মাস খানেক পরে তার বউমা আমার কাছে আসলে বললাম... তোমার শ্বশুরের কি খবর??

বলল... খেত কোপাচ্ছে। ওল লাগাবে।

তারপর অনেক দিন হয়ে গেল। আত্মীয় মানুষ, মাঝে মাঝে খোজ খবর নিই। তার বউমা মানে আমাদের মেয়ের কাছে শুনলাম নৌকার পাশ করে জঙ্গলে গেছে গোলপাতা কাটতে। জীবনের প্রথম রুগীটার এমন নাটকীয় আরোগ্যলাভে আমার নিজের মধ্যে একটু সুখ সুখ ভাব হত। কিছুটা সুনাম ও ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু একটা যায়গায় ভীষন খারাপ লাগত। সূস্থ্য হবার পরে উনি কোন ওষুধ আর খেতেন না। কি যেন একটা ডাক্তার/ কবিরাজ দেখিয়েছে, সে নাকি বলেছেঃ সুস্থ্য মানুষ ঔষধ খাবে কেন?? সত্যিই তো!! সূস্থ্য মানুষ ওষুধ খাবে কেন??

উনি কি সব মাদুলী নিয়েছে, আর গাছের ওষুধ। আমার দেয়া Ecosprin, Osartil বন্ধ করে দিয়েছে। আমি বুঝিয়ে
বললামঃ স্ট্রোক কিন্তু আবার করবে। ফলাফল শুন্য।

তার প্রায় দুইমাস পরে আমার শুক্রবারের চেম্বারে উনাকে অজ্ঞান অবস্থায় ভ্যানে করে নিয়ে এসেছে ( পুনরায় স্ট্রোক করেছে) এবং তার পরের দিন উনি মারা গেছেন।

উনি একেবারেই হালকা গড়নের, কর্মঠ, মেদ ভুড়ীহীন, কর্মজীবি মানুষ ছিলেন। বয়স খুব বেশি না। বিজ্ঞান কে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার গোড়ামি আর অন্ধ অবিশ্বাসে মূল্যবান একটা জীবন ঝরে গেল।
.
উনার মৃত্যুর জন্য উনাকে এবং উনার পরিবারকে আমি আসলে কোন দোষ দেই না। মানুষের সাইকোলজিটাই আসলে এইরকম --সূস্থ্য মানুষ ওষুধ খাবে কেন??

একজন মানুষ খাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাজ কর্ম করছে। সে ওষুধ খাবে কেন?? পকেটের পয়সায় আপাত সূস্থ্য কোন মানুষ ওষুধ কেনা টাকে ভয়ানক অপচয় মনে করে। কেউ যদি জোর করে কিনেও দেয়, সেটা খাইতেও বিশাল অসুবিধা। কারো কারো বিভিন্ন রোগে ১০-১২ টা বা তারও বেশি ওষুধ খাইতে হয়। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত যেকোন মানুষের জন্য এই বাড়তি খরচটা বড় রকমের একটা ইকোনোমিক্যাল ব্যাপার।

এই অবস্থায় কেউ যদি ওষুধের বিকল্প কোন পথ দেখায়, তো সে আসমানের চাঁদ হাতে পায়। তাই সেটা তাবিজ হোক, হোমিওপ্যাথি হোক, কবিরাজি হোক, এক্ট্রাভার্জিন তেল হোক, কোন পীরের পানিপোড়া, ইউটিউবের কোন ভিডিও, কোন কিছুতেই তার আপত্তি থাকে না।

যে দেশে ন্যুনতম হেলথ ইনসুরেন্স নেই, চিকিৎসার জন্য হাজার হাজার টাকা নিজের পকেট থেকেই খরচ করতে হয়, সেই দেশে চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িত প্রতিটি মানুষকেই আসলে ডাকাত মনে হয়।

অথচ চিকিৎসা সারা পৃথিবীতেই ভয়াবহ খরচের একটা ব্যাপার। বিদেশে চিকিৎসা নিতে গেলেই সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। বেশিরভাগ উন্নত দেশে হেলথ ইনসুরেন্সের কল্যানে মানুষ প্রায় বিনা চিকিৎসায় সেবা পায়, যেটা বাংলাদেশে প্রায় শুন্য।
.
আমার মারা যাওয়া রুগীটার কথায় এবার আসি। স্ট্রোক, হার্ট এ্যাটাক, রক্তনালীর বিভিন্ন রোগ, হার্টের যেকোন অপারেশন, রিং পরানো ইত্যাদি রোগে Aspirin (Ecosprin) একটা জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। সমগ্র জিন্দেগী আপনাকে এই ওষুধ টা খেতে হবে যদি বেচে থাকতে চান। আপনার রক্ত তরল রাখার জন্যই এই ওষুধটা প্রয়োজন। নইলে রক্ত জমাট বাধবে। সাথে অবশ্যই প্রেসারের ওষুধ খেয়ে প্রেসার কন্ট্রোলে রাখতে হবে।

সুতরাং কেউ যদি বলে : ওষুধ ছাড়াই হার্টের, স্ট্রোকের চিকিৎসা করুন।

কষে তার পাছায় দুইটা লাথি দিন। আমার রুগীর মত আপনাকেও সে মারতে চাইছে।
.
কিছু Autoimmune disease ( Psoriasis, Arthritis, SLE, etc) , এ্যাজমা, কিছু ডায়াবেটিস, কিছু হরমোন জনিত রোগ, ইত্যাদি মানুষের জিনগত ব্যাধি, জন্মগত রোগ। ওষুধপত্র খেয়েই আপনাকে বেচে থাকতে হবে।

মানুষের গড়আয়ু যখন ৪৫ ছিল, তখন বিনা ওষুধে এই মানুষগুলো মারা যেত। বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা ব্যাবস্থার উন্নতি, ও এই রোগগুলোর কার্জকর ওষুধ আবিষ্কার হওয়ায় এই মানুষ গুলো দীর্ঘায়ু পেয়েছে এবং গড় আয়ু ৭০ এর বেশি হয়েছে। এই রোগগুলো আপনার জেনেটিক কোডেই আছে।

কোন যন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুক, পানিপড়া, হিমালয়ান পিংক সল্ট, লাইফস্টাইল এই রোগ আপনার শরীর থেকে নির্মুল করতে পারবে না। বড় জোর কমাইতে পারবে। একটা নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে ওষুধ খেয়েই আপনাকে বেচে থাকতে হবে।

লাইফস্টাইল চেঞ্জ করে আপনি ওষুধ খাওয়া কমাইতে পারবেন, কিন্ত আপনার জেনেটিক্সে মিশে থাকা এই রোগ থেকে আপনার মুক্তি নাই।

তাই কেউ যদি মিষ্টি কথায় বলেঃঃ ওষুধ ছাড়াই এ্যাজমা থেকে চিরতরে মুক্তি, ওষুধ ছাড়াই ডায়াবেটিস থেকে চিরতরে মুক্তি।

তখন বুঝে নিবেন তিনি মিষ্টি কথায় একজন ভন্ড বাবা। এই বিজ্ঞাপন গুলো সাধারনত কলিকাতা হারবালের সেক্সের বিজ্ঞাপনে থাকে। মেডিকেল সাইন্সের টেকনিক্যাল জ্ঞান আপনার না থাকলে সাধারন মানুষ হিসেবে আপনি প্রভাবিত হবেন এবং রাতারাতি আপনি তাকে পীর ভাবা শুরু করবেন।

কারন আপনি জানেন না ডায়াবেটিস কয় প্রকার। কিছু ধরনের ডায়াবেটিস আছে যেটা জন্মগত এবং আপনি ইনসুলিন ছাড়া বাচবেন না।১৯২২ সালে Ilylili নামক আমেরিকান কোম্পানি ইনসুলিন বাজারে না আনলে এই মানুষগুলো বেশিদিন বাচত না।

ডায়াবেটিসের জটিলতায় সবচেয়ে বেশি মারা যায় DKA ( Diabetic Ketoacidosis) হয়ে। মেডিকেল কলেজে আসলে আপনি দেখতে পাবেন প্রতিদিন কিছু রুগী এই জটিলতায় মারা যাচ্ছে। ইনসুলিন ডিপেনডেন্ট এই রুগীকে আপনি যদি নো কার্ব কিটো ডায়েট করান তো আরো কিটোন বডি তৈরী হবে শরীরে এবং পরিনতি DKA হয়ে মারা যাওয়া। দেশের প্রতিটা হাসপাতালে খোজ নিলে দেখবেন ঘটনা আসলে এটাই।
...
আপনার প্রশ্ন আসতে পারে অনেকেই তো ভাল আছে কিটো ডায়েট করে।

আমার প্রশ্ন হলঃঃ দেশের কোন নিউট্রিসনিস্ট ( পুষ্টিবিদ) এই ফর্মুলা আপনাকে দিয়েছে?? আপনি যে ভিডিও দেখে এগুলো করছেন সেখানে এর দীর্ঘমেয়াদী ভয়ঙ্কর প্বার্শপ্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু বলা আছে?? আপনাকে কেউ কি বলেছে এই ডায়েটে আপনার গড় আয়ু কমে ৪৮% কম বাচতে পারেন? অন্যদের থেকে আপনার ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ৩৮% বেশি? আপনার ভয়ঙ্কর প্যানক্রিয়াটাইটিস, স্ট্রোক হবার সম্ভাবনা প্রায় ৪২ ভাগ বেশি??

একটা প্রবাদ আছে :  গুগল করে কখনও চিকিৎসা নিতে নেই। বিপদই বেশি হয়।
.
তারপরেও মানুষ দ্রুত ওজন কমানোর জন্য এইগুলো করবে। এর কারন কম্পাউন্ড ইফেক্ট। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এই কম্পাউন্ড ইফেক্টকে অষ্টম আশ্চার্য বলেছেন। ঠিক যে কারনে বিড়ি সিগারেটের হাজার রকমের ক্ষতিকর প্রভাব থাকা সত্বেও এদেশে লাখ লাখ মানুষ সিগারেট খায়, একই কারনে কিটোডায়েটের আরো ভয়ঙ্কর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকা সত্বেও লাখ লাখ মানুষ সেইটা ফলো করবে।

এমন যদি হত দুই দিন বিড়ি খেয়ে তৃতীয় দিনে মানুষটা ছটফট করে মারা গেছে, তখন সত্যিই কেউই আর বিড়ি খেত না। সত্যিকার অর্থে বিড়ি খেয়ে সরাসরি কেউই মারা যায় না। কিন্তু বিড়ি খাওয়ার ফলটা সে পাবে ২০-৩০ বছর টানা বিড়ি খাওয়ার পরে। অনেকে তো সারাজীবনে বিড়ি খেয়েও ৯০ বছর বেচে যাবে।

একই ভাবে লো কার্ব, নো কার্ব কিটো ডায়েট করেও সাথে সাথে কারও ক্ষতি নাও হতে পারে। অনেকের ওজন কমে স্লিম হয়ে সুন্দর হয়ে যাবে। বডি শেমিং এর এই কুৎসিত সমাজে একটু ওজন কমিয়ে ভাল ভাবে থাকার জন্য মানুষ এইটা করবে। কিছু বললে বলবেঃঃ অমুক তো ভাল আছে। ওজন কমে গেছে, সুন্দর আছে।

কিন্তু এর খারাপ দিকগুলো একজন ডাক্তার হিসেবে আপনাদের জানানো উচিত। পৃথিবীর কোন দেশেই কোন এথলেট কিন্তু এই তরিকায় ওজন কমায় না। অনেক খেলোয়াড় ফিটনেস এর অভাবে টিমে চান্স পায় না। তবুও সে কিন্তু ১৫ দিনে ৭ কেজি ওজন কমানোর এই কবিরাজি ফর্মুলা ফলো করে না।

কারণ বিজ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে আসলে কিন্তু পালানোর জায়গা নেই। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান, পরিমানে কম খেয়ে ব্যায়াম করে ওজন কমান। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দেখেন.. এরা এভাবেই ফিট থাকে। কোন লাইফস্টাইল এর দরকার হয় না। মিথ্যা তথ্য মিথ্যাই তাই সেটা যত ধর্মীয় লেবাসে বলা হউক বা যত মিষ্টি কথায় বলা হউক। আর সত্যটা একটু তিতা, কর্কশ।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল