হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ প্রদান করেছেন। এ ভূখণ্ডের জনমানুষের চিন্তাচেতনা আর আশা-আকাঙ্খার প্রতিচ্ছবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রজীবনে ঢাকা-কলকাতা চলাফেরা এবং বিভিন্ন ব্যক্তি-জনের কাছে মুজিবুর রহমান নামে একজন উদীয়মান তরুণ বাঙালি নেতার কথা শুনতাম। পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সংবাদের সুবাদে তাঁর সম্পর্কে আমার একটি উচ্চ ধারণা সৃষ্টি হয়। তখনো তাঁর সাথে সরাসরি দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা অবস্থায় তাঁর সাথে আমার সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ হয়। প্রতিদিন বিকেলে দেখতাম লম্বা সুদর্শন ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শেখ মুজিবুর রহমান একটি হিলম্যান গাড়িতে এই এলাকায় আসতেন। মুখে থাকত তাঁর বিখ্যাত পাইপ। সব সময় সামনে থাকত ২০-২৫ জন ভক্ত-অনুসারী। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ অভিভাবকত্বের ও নেতৃত্বের আদলে সবার কুশল জিগ্যেস করতেন। তাঁর কথোপকথনে আশপাশে উপস্থিত জনসাধারণ মুগ্ধ হয়ে যেত। তাঁর প্রতি আমার ভক্তির শুরু তখন থেকেই। তাঁর অপরিসীম ব্যক্তিত্ব সবার মন জয় করে নিত। ষাটের দশকের শেষ দিকে দেশ-বিদেশে যেখানেই ভ্রমণের সুযোগ এসেছে, বারবার একটি প্রশ্ন বিদেশিদের কাছ থেকে এসেছে, শেখ মুজিবুর রহমান কত বড় নেতা?
এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট-বড় অনেকেরই শেখ মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ছিল। প্রশ্ন করত তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলি, আদি নিবাস প্রভৃতি সম্পর্কে। আমি সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থক ও প্রচারক। আমি জোর গলায় তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করতাম। বলতাম, ও বহৎ বড়িয়া আদমি হ্যায়। উমদা আদমি হ্যায়। সাচ্চা মুসলমান হ্যায়। আমার কথাগুলো লাহোরের অভিজাত শ্রেণির মানুষদের আশ্বস্ত করত। তারা ভাবত যে, পূর্ব পাকিস্তানে একজন দেশপ্রেমিক নেতার আগমন ঘটেছে।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ব্যবসায়িক কাজে লাহোরে ভ্রমণের সময় আমি বেশ কিছুদিন আটকে থাকি। লাহোরে হোটেলে থাকাকালীন হোটেলের অন্যান্য বিদেশি অতিথির সাথে আলাপ-আলোচনায় তারা শেখ মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে চাইত। আমি বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করে তাদের কিছু ভুল ধারণা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। তবে তখনো আমি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সাথে বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হওয়ার সুযোগ পাইনি। সেই সুযোগ এলো ষাটের দশকের শেষে, যখন আমি ঢাকার কলাবাগান এলাকায় বসবাস শুরু করলাম। কলাবাগান থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যাতায়াত দূরত্ব বেশি নয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা থাকার সুবাদে আমি প্রায়শই বিকালে তাদের সঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যাতায়াত করতাম। সে সময়ই দেখতাম দলে নেতাকর্মীদের ও সাধারণ মানুষের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর বাঙালি জাতির বাতিঘর ৩২ নম্বর সড়কের সেই দোতলা বাড়িটি। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর সড়কের সেই বাড়িটি ছিল আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। রেসকোর্সের মাঠে ৭ই মার্চের ভাষণ শোনার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেছিলাম। সেদিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে কলাবাগান থেকে দলবলসহ লাঠিসোঁটা নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হই। সেই ভাষণ আজও প্রাণে লেগে আছে। সেই বজ্রকণ্ঠ, সেই উদাত্ত আহ্বান, সেই দীপ্ত শপথ- যা বাঙালি জাতির মনে স্বাধীনতার বীজ বপন করে। আমরা উদ্দীপ্ত হই। জাতি প্রস্তুত হয় স্বাধীনতাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর মোহ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী না হওয়ায় সভা-সমাবেশে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ মিলত না। এ সময় জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য যাচ্ছেন। মনস্থ করলাম আমি বঙ্গবন্ধুর জনসভায় অংশ নেব। আমি সপরিবারে ব্যক্তিগত গাড়িতে সড়ক পথে কলকাতার পথে রওনা দিলাম। গাড়ি বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত পতাকায় সজ্জিত করে যশোরের বেনাপোল অতিক্রম করে ভারতের মাটিতে প্রবেশ করলাম। আমরা ভারতের মাটিতে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম। দেখলাম পথচারীরা আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছে, অনেকে আবার দুহাত জোড় করে ভক্তিভরে প্রণাম করছে। আমরা এক দিকে হতচকিত হয়ে গেলাম আবার আনন্দিতও হলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, মানুষের এত ভক্তিভাব আমার জন্য নয়, গাড়িতে লাগানো জাতির পিতার ছবির জন্য। আমার হৃদয় আবারও জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে উঠল।
বাঙালি জাতিকে স্বপ্ন দেখতে ও স্বপ্ন অর্জন করতে শিখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু একটি অনুপ্রেরণার নাম। আমার আজও মনে পড়ে ৭ই মার্চের রেসকোর্সের জনসমুদ্রের কথা। আজও কানে লেগে আছে সেই কালজয়ী ভাষণ। সেই যে একটি উদ্দীপনা দেশপ্রেমের মন্ত্রণা- যা স্বাধীনতার পরেও আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে। স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা এ দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে তোলার জন্য কাজ করেছি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ব্যবসাবাণিজ্য গড়ে তোলা সহজ কোনো ব্যাপার ছিল না। আমরা বেসরকারিখাতের উদ্যোক্তারা তখন হাঁটিহাঁটি পা পা করে দেশে ও বিদেশে ব্যবসাবাণিজ্য প্রসারের কাজ করেছি। আমাদের অনুপ্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্প-বাণিজ্য-ব্যাংক-বিমা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশে অসংখ্য শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সচেষ্ট থেকেছি। ১৯৭৫ সাল আমাদের জাতীয় জীবনের কলঙ্কতম অধ্যায়। আজও আমি মনে করি জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া দিকনির্দেশনা শতভাগ প্রাসঙ্গিক।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির উদাহরণ এখন বিশ্বব্যাপী অনুকরণীয় মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমরা উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে সেই একই অগ্রযাত্রায় শরিক হতে পেরে একই সঙ্গে আনন্দিত ও গর্বিত বোধ করি। বিশ্বে আমাদেরকে একটি মর্যাদাবান জাতি হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করার অন্যতম উপায় হচ্ছে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করা। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্য শিক্ষা-গবেষণার অভিযাত্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে। দেশ ও জাতির কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা সদা সচেষ্ট।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে আয়োজিত বছরব্যাপী অনুষ্ঠানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। নতুন প্রজন্মের সামনে বাঙালি জাতির সঠিক ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির চিত্র সঠিকভাবে উপস্থাপনের জন্য আমাদের পাঠ্যক্রমে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি আশা করব ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা পাবে। পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্য রইল আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের জন্য রইল আমার অকৃত্রিম শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
(বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বই থেকে নেয়া)
লেখক : সাবেক সভাপতি, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও এফবিসিসিআই।