নাজনীন সুলতানা :
সেদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছিলাম।
বাসায় অতিথি এসেছিলেন। খালু। উনি বগুড়ায় ব্যাংকে চাকরী করেন। কি যেন অফিসিয়াল কাজে রাজশাহী এসে দুদিন ছিলেন আমাদের বাসায়।
আমি বরাবর দেখে এসেছি যে বাসায় আত্মীয়স্বজন আসার পর তারা ফেরার দিন যখন ভোরবেলায় বাস বা ট্রেন ধরতে যায় - সেটা যতসকালেই হোকনা কেন আমার আম্মা তার আগেই উঠে গরম গরম নাস্তা তৈরি করে খাবার টেবিলে সাজিয়ে দেন।
সেদিনও তাই খুব সক্কালবেলা আম্মা উঠেছিলেন।
স্কুলে যাওয়ার দেরি থাকলেও আমিও আম্মার সাথে সাথে উঠে পরেছিলাম।
তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পূর্বপাড়ার শিক্ষকদের ফ্ল্যাটে আমরা থাকি। সেই বাসার একদিকে বিশাল টানা একটা বারান্দা। খালু চলে যাওয়ার পর আম্মার সাথে আমি রেলিংঘেসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম।
আমি তখন ক্লাশ ফাইভে পড়ি।
বারান্দার রেলিং ঘেষে দাঁড়ালে বাইরের সবকিছুই নিজে নিজে দেখতে পাই।
হঠাৎই আমার চোখে পরল ফ্ল্যাটের ডানদিকে যে সরু পায়ে চলা রাস্তা আছে সেখান দিয়ে খালু দ্রুতগতিতে হেঁটে ফিরে আসছেন।
আমি আর আম্মা দুজনই খুব অবাক হয়ে গেট খোলার জন্য এগিয়ে গেলাম।
আমার আব্বার অভ্যাস হল শীত বা গ্রীষ্ম যাই হোক সক্কালবেলাতেই ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নেয়া। তারপর নাস্তা করে পায়ে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ডিপার্টমেন্টে চলে যান তিনি।
আব্বাও অবাক হয়ে এগিয়ে গেলেন।
খালু ভিতরে ঢুকে উদভ্রান্তের মত এদিকওদিক তাকিয়ে নিচুগলায় বললেন, " বুবু - দুলাভাই, এখানে না। ভিতরে চলেন!"
ঘরে ঢুকে তেমনই এক উদভ্রান্ত অস্থির গলায় বললেন, "বঙ্গবন্ধুকে নাকি মেরে ফেলেছে!"
এবার সেই উদভ্রান্ত দৃষ্টি চলে এল আমার আব্বা - আম্মার চোখে। তাঁরা অবাক গলায় প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, " আরে, কি বলছ এসব? কে বলল তোমাকে?"
খালু বললেন, " সাইন্স ল্যাব পর্যন্ত যেতে দেখি রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি ঘোড়া প্রায় নাইই। রাস্তার লোকজনই ফিসফাস করে বলছিল এসব কথা। রেডিওতে নাকি ঘোষণা দিচ্ছে!.. .... ও বুবু, রেডিওটা ছাড় তো!"
একাত্তরে আমি খুবই ছোট ছিলাম। তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। একাত্তরের কিছু কিছু স্মৃতি আমার মনে আছে। তারমাঝে একটা স্মৃতি মনে পরে। অনেক সকালে বা সন্ধ্যায় রেডিও খুব আস্তে চালিয়ে, রেডিওর গায়ে প্রায় কান ঠেকিয়ে আব্বা - আম্মা আর বড়মামা খবর শুনতেন।
আজও ঘরের মাঝে সেই শুনশান নিরবতা।
তেমনই রেডিওতে চাপা গলায় কথা ভেসে আসা। তেমনই প্রায় রেডিওতে কান ঠেকিয়ে একটা একঘেয়ে অথচ নির্মম গলায় বারবার উচ্চারিত কথা শুনলাম আমরা, " আমি মেজর ডালিম বলছি.... ...! "
হত্যার এমন দাম্ভিক ঘোষণা আমি সেদিন প্রথম শুনেছিলাম!
বড়রা কি বলছে, কি করছে তা আর কিছুই দেখিনি আমি। অজান্তেই চোখ পানিতে ভরে উঠেছিল। আমি দৌড়ে ঘরে যেয়ে আমার স্কুল ব্যাগ থেকে সমাজ বইটা বের করেছিলাম। দ্রুত হাতে পাতা উল্টিয়ে বের করেছিলাম ইতিহাসের অংশ। যেখানে পাতার ঠিক মাঝখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি। সাদাকালো। কি জীবন্ত, কি মায়াভরা প্রসন্ন মুখ!
তখনো পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে হয়তো অনেক কিছু জানি, হয়তো-বা অনেকটাই জানিনা। কিন্ত সেই সময় পর্যন্ত তাঁকে ঘিরে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি ছিলো খুবই অল্প। এরমাঝে দু'একটা ঘটনা খুব বেশি মনে পরে। '৭১ এ আমার বয়স ছিলো মাত্র ৬+ বছর। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বপাড়ায় থাকতাম। সেই ফ্ল্যাটের পিছনেই ছিলো ছাত্রদের হল যা সেসময় টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেজন্য ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পূর্বপাড়ার বেশ কয়েকটা পরিবারকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পশ্চিমপাড়ার আবাসিক এলাকায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।
আমরা উঠলাম পশ্চিমপাড়ার ৭১ নাম্বার ফ্ল্যাটের একতলা পূর্বদিকের বাসায়।
ওখানে থাকা অবস্থায় দেশ স্বাধীন হলো। সেসময় বড়দের কাছে শুনতাম যে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরবেন। আমার মতো বয়সীদের কাছে তখন দেশ মানে তার অনেকটা জুড়ে রাজশাহী এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বঙ্গবন্ধু দেশে আসবেন মানে ক্যাম্পাসে আসবেন এমন একটা বিশ্বাস থেকে আমরা প্রতিদিন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ফুলগাছ থেকে ফুল নিয়ে মালা আর তোড়া বানিয়ে রাখতাম।
'৭৩ এ বঙ্গবন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। কেমিষ্ট্রি বিল্ডিংয়ে অনুষ্ঠান হয়েছিলো। আমি তখন থ্রি'তে পড়ি। ছোট ভাইদু'টো আরও ছোট। সেই অনুষ্ঠানে ছোটদের নিয়ে যাওয়া বারণ ছিলো বলে শুধু আব্বা আম্মা সেখানে গিয়েছিলেন। ওনাদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার সেই স্মৃতিচারণ অনেক অনেকবার শুনেছি।
আমি তখনও পর্যন্ত কোন আপনজনের মৃত্যু দেখিনি।
সেই প্রথমবারের মতো আমি মৃত্যু শোক অনুভব করেছিলাম। কষ্টে বুক ভরে উঠেছিল।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলনা যে এটা কিভাবে সম্ভব? এত ভালবাসার এত আপন একজন মানুষকে কি এভাবে মেরে ফেলা যায়?
ব্যাগ থেকে খাতা বের করে সাদা পাতায় পেন্সিল দিয়ে এলোমেলোভাবে প্রিয় সেই নামটা নিয়ে কি কি যেন লিখছিলাম বারবার।
একসময় দেখলাম আম্মা পাশে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে আমার খাতার লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন।
আব্বা আমার মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বললেন, "আজ খাতাটা বন্ধ করে তুলে রেখে দাও, মা। পরে কোন একদিন নিশ্চয়ই ভালভাবে এই কথাগুলো লিখতে পারবে!"
সেটা ছিল ১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫!
সত্যিকার অর্থে সেদিনই আমি মৃত্যুশোক প্রথম অনুভব করেছিলাম!