আগস্ট মাসের ৭-১৫ পর্যন্ত ছিল জাপানের গ্রীষ্মকালীন ছুটি। জাপানীজ নাগরিকসহ প্রবাসীদের মধ্যে অনেকেই এ বছরের ছুটিটা বেশ আনন্দ চিত্তে উপভোগ করেছে। আর এ সুযোগে জাপানের নতুন অতিথি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মনের আনন্দে ছড়িয়ে পড়েছে জাপানের ঘরে ঘরে। পিসিআর টেস্ট এর ফলাফলে প্রতিদিন নতুন করে করোনা সংক্রমণের রেকর্ড লিখতে হচ্ছে। এই রেকর্ডে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবদানও বেশ ভালো। টোকিও শহরের ছোট্ট মহল্লা হিগাসি জুজু তে ৫০ এর অধিক বাংলাদেশি গত কয়েক দিনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, অবশ্য কাওয়াগুচি (সাইতামা), গুনমা, আশিকাগা সহ বেশ কিছু শহরে অনেক বাংলাদেশী পরিবার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এই মুহূর্তে জাপানের হাসপাতালে একটি করোনা বেড পাওয়া বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার, এমনকি সরকার নির্ধারিত করোনার জন্য ব্যবহৃত হোটেলগুলোতে একটি রুমও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আক্রান্তদের প্রায় সবাইকে নিজ নিজ বাসায় অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
বাসায় চিকিৎসা নিতে যে সমস্যাগুলো হচ্ছে :
১। অক্সিজেন সেচুরেশন হঠাৎ করে কমে গেলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অক্সিজেন পাচ্ছে না, শ্বাসকষ্টে ছটফট করছে অনেক রোগী। বেশ কিছু প্রবাসী বাংলাদেশী রোগীও শ্বাসকষ্ট নিয়ে দিন গুনছে হসপিটালে একটি বেডের জন্য।
২। পরিবারের সবাই (দুধের শিশু সহ বৃদ্ধ) একসাথে আক্রান্ত হওয়াতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত রোগীর পরিবারের সবাই কে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন থাকতে হচ্ছে যার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারসহ অন্যান্য জিনিসও কেনা সম্ভব হচ্ছে না। সরকার খাদ্য সরবরাহ করার চেষ্টা করলেও সেগুলো ঠিক সময়ে পৌঁছাচ্ছে না, ফলে আক্রান্তদের পরিবার ভয়াবহ অবস্থায় দিন পার করছে।
৩। আক্রান্তদের পরিবারের প্রত্যেকেই বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন থাকার কারনে অফিস/ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে।
এই মুহূর্তে যে পরিস্থিতি তাতে আক্রান্ত হতে পারে যে কেউ, তাই সাবধানে থাকার পাশাপাশি খাবারদাবার সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ। বিশেষ করে যাদের ছোট বাচ্চা আছে, তাদের অবশ্যই বাচ্চার প্রয়োজনীয় খাবার সংগ্রহ করা রাখাটা দরকার। এমনিতে জাপানে সাপ্লাই এর অভাব নেই, তবে কোয়ারেন্টাইন থাকতে হলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করাটা অসম্ভব হয়ে যাবে।
রেকর্ড সংখ্যক আক্রান্তের পরও সুসংবাদটি হল, করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। প্রতিদিন ২৫০০০+ আক্রান্ত হলেও মৃতের সংখ্যা ২০-৪০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। এর কারন ৫০ এর বছরের উর্ধ্বদের মধ্যে ব্যাপকহারে টিকা প্রয়োগ। জাপানের মোট জনসংখ্যার ৫০% এর অধিক ইতিমধ্যে টিকার আওতায় চলে এসেছে, যা আগামী অক্টোবরের মধ্যেই ৮০% হয়ে যাবে।
মৃত্যুর হার কম হওয়াতে জাপান সরকার সম্ভবত নতুন করে কোন শক্ত লকডাউনে যাবে না। তবে ভয় পাচ্ছে গরমের ছুটি শেষে সেপ্টেম্বরে বাচ্চাদের স্কুলে ফেরা নিয়ে, কেননা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হচ্ছে ০-২০ বয়সীদের মধ্যে কারন এদের মধ্যে ভ্যাকসিনেশনের হার প্রায় শুন্য।
অনেকের মনে প্রশ্ন আসছে জাপান এত উন্নত হওয়ার পরও কেন চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলায় যেমন একটি প্রবাদ আছে, ছাগল দিয়ে কখনও হালচাষ হয় না, তেমনি করোনা রোগীর চিকিৎসায় ডেটিকেটেড ডক্টর, নার্স ছাড়া করোনা চিকিৎসা সম্ভব নয়। এবং সরকার চাইলেও হঠাৎ করে হাজার হাজার ডাক্তার নার্স নিয়োগ দিতে পারছে না, আবার হসপিটালে নিয়োজিত বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তার নার্সদের তাদের নিজস্ব ডিপার্টমেন্ট রোগী বাঁচাতে ব্যস্ত হওয়াতে তাদের কে করোনা চিকিৎসায় নিয়োগ করতে পারছে না।
এই মুহূর্তে যে কেউ যে কোন সময়ে আক্রান্ত হতে পারে, তাই পরিচিত কেউ আক্রান্ত হলে তাকে যতটুকু সম্ভব সাপোর্ট দেয়াটা খুব দরকার। কেউ আক্রান্ত হলে পরিচিত বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীকে জানানোটা জরুরি।
যারা ভ্যাকসিন নিয়েছে তাদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে তবে তাদের হসপিটাল পর্যন্ত যেতে হচ্ছে না।
করোনায় মৃত্যু না হলেও এটা শরীরে কতটুকু ক্ষতি করে রেখে যায় সেটা আপনার পরিচিত আক্রান্ত কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারবেন।
আসুন প্রবাসে একজন আরেকজনের বিপদে পাশে থাকি। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
লেখক : লিংকন, রিসার্চ ডিরেক্টর, মিতসুবিশি কেমিক্যাল অ্যাকুয়া সল্যুশন্স।
টোকিও ২৯২১.০৮.২২
সময় জার্নাল/