বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

কবি সানোয়ার জাহানের কবিতা ও কাব্যভাবনা

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২১
কবি সানোয়ার জাহানের কবিতা ও কাব্যভাবনা

সাইফুল ইসলাম :
কবি সানোয়ার জাহান ভূইয়ার সাথে আমার প্রথম পরিচয় নব্বইয়ের দশকের কোনো একটা সময়ে। তারপর থেকে আমি তার কবিতা ও লেখার অনুরক্ত, অনুগামী। তার কাব্যচর্চা, কাব্য ভাবনার, কাব্যাচরনের নিরন্তর দর্শকও বটে। যে কবিরা কয়েকটা কবিতা লিখে হৈ-হুল্লোড় ফেলে দেন তার পর আর তাদের ঝুলিতে কবিতা নামক বস্তটা থাকেনা তিনি সে দলের কবি নন।
দীর্ঘ সাধনায়, অধ্যয়নে তিনি কবিতা লেখার যে ধারাটা নিজের করে নিয়েছেন তা বিরল, স্বতন্ত্র ও উপভোগ্য। কবিতার প্রয়োজনে, একটা নিজস্ব স্টাইল রপ্ত করার জন্য তিনি বাংলা কবিতার ব্যাকরণ, ছন্দের পাঠ রপ্ত করেছেন; নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন কালিদাস, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মহাদেব সাহা, আল মাহমুদসহ আধুনিক ও যুগপৎভাবে উত্তর আধুনিক স্হানীয় ও আন্তর্জাতিক কবি, সাহিত্যিক সমালোচকদের কবিতা ও রচনা ব্যবচ্ছ্যেদ করে করে। কবিতায় নিজস্ব শব্দ, বাক্য ব্যবহারের সাথে সাথে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিথ, বিশেষ করে গ্রীক মিথের সফল ব্যবহার করেছেন ল। কিন্তু এ প্রয়াস তাঁর কবিতার নিজস্বতাকে কখনো ছাপিয়ে যেতে পারেনি, অর্থাৎ তিনি কবিতায় নিজস্ব আঙ্গিকে মিথের ব্যবহার করেছেন। তিনি নিজস্ব শব্দে কবিতার শরীরকে সমৃদ্ধ করেছেন, প্রকৃতি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে কবিতাকে প্রাণ দিয়েছেন আবার মিথের উপাদানকে আধুনিকতার পাশে রেখে প্রত্যক্ষকে প্রচ্ছনের সাথে, বর্তমানকে অতীতের সাথে লীন করে দিয়ে কবিতায় সৃষ্টি করেছেন পলিমাটি-ভরা এক সংযোগভূমি।
কালিদাসের মেঘদূত থেকে অনুবাদ করে সহজপাঠ্য কথামালা যেমন পাঠকদের উপহার দিয়েছেন তেমনি তার নিজস্ব ঘরানার কবিতায় সাক্ষর রেখেছেন অপূর্ব দক্ষতার।
তাঁর অনুবাদকৃত মেঘ মঙ্গল থেকে একটি উদ্ধৃতি দিতে হয়-
"হে প্রিয় মেঘ
তোমার আগমনে দশার্ণ দেশের উদ্যানের বেষ্টনীসমূহ কেতকী (কেয়া) ফুলে ছেয়ে যাবে থরে-বিথরে; পাড়ায় পাড়ায় গাছেরা আকুল হবে কাক-শালিকের বাসা বানাবার আবাহনে; বনানীরা সেজে ওঠবে সবুজে-শ্যামলে এবং সুপুষ্ট জম্বুফলের পরিণত গৌরবে; আর, পথের ক্লান্তি ভুলে, মানসসরোবরগামী হংস-বলাকারা মগ্ন হবে জলকেলিতে।"
তাঁর প্রথমদিককার কবিতাগুলোর অধিকাংশই রোমান্টিকতা আশ্রয়ী হলেও সাম্প্রতিক রচনাগুলো বহুমাত্রিক।ইদানীংকালের রচনায় আমরা খুঁজে পাই কবিতায় জীবনবোধের ব্যবহারে সিদ্ধহস্তার প্রমাণ-
'আমাদের হাঁটা হয়নি অনেক পথ' কবিতায় কবি নিসর্গের বুকে বিচরণের অতৃপ্তি থেকে যখন বলেন,
আমাদের বাকি থেকে গেছে অনেক প্রহর।
গোধূলির পাশাপাশি যাওয়া হয়নি তোমার খুঁজে।
খোঁজা হয়নি তোমার পরশ শিশিরের ভাঁজে ভাঁজে।
আমাদের ছোঁয়া হয়নি
গোমতীর জল উজানের ঘাটে ঘাটে।
আমাদের দেখা হয়নি ডানকানা মাছ, ইলিশের ঝাঁক
হাওরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে সরপুটি মাছ।
তখন প্রকৃতি প্রেমের সাথে জীবনের গতিকে একাকার হয়ে যেতে দেখি।
তাঁর সাম্প্রতিক কবিতায় তিনি নিখাত রোমান্টিক স্মৃতিকে আশ্রয় করে লিখেছেন-
তোমাকে খুবই নির্ভার মনে হয়েছে গতকাল।
মনে হয়েছে
চৈত্রের নিদাঘে খোলস ফাটিয়ে বেরিয়ে পরা
একখন্ড কার্পাস তুলো,
যেন, মেঘের কোলে মিশে যাওয়া একজোড়া
পরীর ডানা,
কিংবা, সন্ধ্যার বাতাসে ভেসে বেড়ানো
একগুচ্ছ মায়াবী হাস্নাহেনা....
'তোমাকে খুবই দুর্বিনীত মনে হয়েছে গত মংগলবারে।
ঠিক সেই সময়ের মত, যখন ভাবতে পারতে--
জীবন, ঠিক সুতোছেঁড়া ঘুড়ির মতই,
যেদিকে ইচ্ছে ঘুরিয়ে নেবো।
একগুচ্ছ পুষ্পিত জারুলের ডাল গালের প্রান্তে ঘষতে ঘষতে....
যেমন তুমি ভাবতে,
ল' ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে এলিজেবল
লেকচারারের প্রস্তাব আমি ফিরিয়ে দেবো,
অথবা, আলমের বিপুল বিত্ত বৈভবের কাছে
আমার চুলের অহংকারের পতন ঘটাবো না,
আমি প্রণত থাকবো সেই মায়াবী অক্ষরের কাছে
যার দিকে তাকিয়ে থাকলে বাগানের সমস্ত
গোলাপ আমার বুকে ছড়িয়ে দেয় এক আকাশ
বিশুদ্ধ সৌরভ।
তাঁর আরেকটি মনছোঁয়া কবিতা 'তোমার বেহুলা-অহংকারের প্রতি' এর পরতে পরতে যে শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার কারুকাজ তা কবিতার ক্রান্তিকালে বিরল উদাহরণ। যেমন কবি দ্বিতীয় পঙক্তিতে লিখেছেন-
'যে গোলার্ধ্ব সূর্যকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি
যার উঠোনে নিত্য এসে
দোয়েলেরা কলকাকলিতে মুখরিত হয়
যার বাগানের ফুল পাপড়ি প্রজাপতি-রং
খুবই আটপৌরে,
তাকে থামিয়ে কী লাভ বলো।'++++
তৃতীয় পঙতিতে এসে তিনি স্বদেশি ও ভারতীয় মিথের ব্যবহারে যে ঐন্দ্রজালিক আবহ তৈরি করেছেন ইদানীংকার বাংলা কবিতায় তা বিরল--
'মনে করো, তুমি বিপুলা বৈভবে বিদগ্ধ
মনে করো, তুমি বিজয়িনী বেহুলা অহংকারে ঋদ্ধ
মনে করো, তুমি শতাধিক নীলপদ্মে আরাধ্য
ধরো, মেঘের আড়ালে তুমি নভোনীলাপ্রাণ
তাতেও কী তুমি অনতিক্রম্য শৈলপ্রাচীর?'
না, পরিশেষে, কিছুই অনাস্বাদিত থাকেনি।
কিংবা, অনিষিক্ত বলে কোন শব্দই মালির বাগানে নেই,
তারপরও কেনো, টেনে দাও সীমারেখা।
তৃতীয় পঙক্তিতে নিজস্ব স্টাইলে ঐতিহাসিক চরিত্রের ব্যবহার; যেমন-
নির্বানা, সে কি একান্ত ভাবেই সিদ্ধার্থের অধিকার নয়,
ধ্যানী বুদ্ধের আসনে পেতে দেয়া পদ্মকে স্পর্শ করে
যে হ্রদয় পবিত্রপুষ্প
সেখানে সীমারেখা দিও না বন্ধু।
নির্বানা কিংবা পবিত্রতা, সে এক অসীম শুভ্রমেঘমালা
তার হাতে শেকল পরিয়ে দিও না।
কবিতা সম্পর্কে তাঁর ভাবনাও অনন্য। কবিতা নিয়ে একটি লেখায় তিনি লিখেছেন,
”কবিতার শব্দরূপকে আমি অনেক সময় ঐশী বাণীর সাথে তুলনা করতে চাই। কবিতা এমন এক উচ্চারণ যা ভাবনার প্রান্তিকতায় আমাদেরকে নিক্ষেপ করে কিংবা অনুধ্যান ও অনুচিন্তনের এমন এক উপত্যকায় আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখান থেকে উচ্চারিত কথামালা এক পরম ও চরম অনুভব নিষ্যন্দিত ও নিষিক্ত।
এই জন্যই আমি বলি স্বার্থক কবিতা জন্য নিবিড় সাধনা কিংবা গভীর মগ্নতা অপরিহার্য।''
কবিতা সম্পর্কে তাঁর ভাবনা ও রচনা থেকে সহজে বলা যায়, মগ্নতা ও প্রকৃতিচেতনাই তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য। কবিতা সম্পর্কে তাঁর মনন, দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্জন সাধনা তাঁকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে এ কালের আর সব কবিদের থেকে। বিশেষ করে তাঁর নিজস্ব শব্দচয়ন, কবিতার মোহনীয় গাঁথুনি, পরাবাস্ততার ব্যবহার পাঠককে যে প্রশান্তি দেয় এর তুলনা শুধু তাঁর কবিতা। প্রচারবিমুখ এ কবির রচিত কবিতার সংখ্যা অসংখ্য না হলেও নেহায়েত কম নয়। সংক্ষিপ্ত কলেবরে তাঁর বহুমাত্রিক সৃজনগুলো নিয়ে আলোচনা করা যেমন দুরূহ, তেমনি আমার মতো লোকের জন্য কষ্টকর। কবির অনেক অনুরাগী থাকলেও তাঁর কবিতার বই প্রকাশিত হয়নি।

হয়তো তিনি সুযোগ পাননি, হয়তো নিজস্ব চেতনার আশ্রয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখছেন কিংবা নিজেকে যোগ্য থেকে যোগ্যতর করে তুলছেন।

লেখক :

সাইফুল ইসলাম


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল