শুভ কামাল :
নগদ ই সম্ভবত পরবর্তী ইভ্যালি হতে যাচ্ছে। শুধু মগের মুল্লুকেই 'নগদ' এর মত এমন কোম্পানি থাকা সম্ভব। ডাক বিভাগের সেবা বললেও ডাক বিভাগের মালিকানা এখন পর্যন্ত নেই এতে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদন নেই। স্রেফ গায়ের জোরে একটা প্রতিষ্ঠান চলতেছে।
এরা দাবি করে এরা ডাক বিভাগের অংশ, অথচ সরকারকে বা ডাক বিভাগকে না জানিয়েই কোম্পানির নাম বদলেছে, আগে এদের কোম্পানীর অফিসিয়াল নাম ছিল 'থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস', এ বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে সেটাকে 'নগদ' বানিয়েছে। এখানে কনফিউজড হবেন না, তাদের ব্র্যান্ডের নাম আগে থেকেই 'নগদ' ছিল, এখন কোম্পানীর নামও 'নগদ' বানিয়েছে। এখন বাটে পরে বলছে লাভের ৫১% অংশ ডাক বিভাগকে দেয়া হবে। কিন্তু কবে কিভাবে দেয়া হবে সেটা কেউ এখনো জানেনা।
এদের ঋণ আছে ৪১৬ কোটি টাকা। বুইঝেন বিষয়টা। এদের পরিশোধিত মূলধন অর্থাৎ সোজা বাংলায় নিজের পকেট থেকে কোম্পানীতে দেয়া টাকা মাত্র ৩.৫ কোটি। এখন ওরা জিরো কুপন বন্ড ছাড়তে চলেছে বাজার থেকে ৫০০ কোটি টাকা তোলার জন্য, এজন্য সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনে আবেদন করেছে। বিষয়টা সহজ করে বলি, তারা মানুষের কাছ থেকে বন্ড হিসেবে টাকা তোলার জন্য সরকারের পারমিশন চাচ্ছে, যেন তারা ইনভেস্টরদের তথা জনগণকে বলতে পারে তোমরা ভাগে জোগে আমাকে ৫০০ কোটি টাকা জোগাড় করে দাও, বিনিময়ে পাঁচ বছর পর আমরা তোমাদের লাভসহ ৭৫০ কোটি টাকা ফেরত দিব। বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটের শেয়ারের মত 'নগদ' কোম্পানীর বন্ড, বুইঝেন কিন্তু বিষয়টা!
যাইহোক সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের এমন মূলধন তোলার অনুমতি দিতে হলে পর পর তিন বছর কোম্পানী লাভ করেছে সেটা দেখাতে হয়। অথচ তিন বছরে নগদের ঋণ হয়েছে ৪১৬ কোটি, লাভের ত প্রশ্নই নাই! যে কোম্পানী তিন বছরের কম সময়ে ঋণ করেছে ৪১৬ কোটি, তারা পাঁচ বছর পরে ইনভেস্টরদের ৭৫০ কোটি টাকা ফেরত দেবে এইটা ভাবতে ইভ্যালির রাসেলের চেয়েও বেশী আশাবাদী হতে হয়।
ডেইলিস্টারের রিপোর্টে দেখলাম নগদ দাবি করছে 'কিউ-গ্লোবাল' নামক এক আমেরিকান কোম্পানী নাকি ৩০ মিলিয়ন ডলার তথা ২৫৪ কোটি টাকার নগদের বন্ড কিনবে বলে আগ্রহ দেখিয়েছে তাদের আয়োজনে আমেরিকায় করা রোড শো তে।
আমি গুগল করে দেখলাম 'কিউ গ্লোবাল' কোন ইনভেস্টর কোম্পানী না। এটা একটা প্লাটফর্ম যেখানে ইনভেস্টর আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কমিউনিকেট করতে পারে। 'কিউ গ্লোবাল' ব্যক্তিগতভাবে কোন ইনভেস্টমেন্ট করেনা, বা করতে আগ্রহ দেখায় না, শুধু দুই পার্টির মাঝে যোগাযোগ করিয়ে দেয়! তার মানে এইটাও পুরাই চাপা!!
যাইহোক কোন আইনের তোয়াক্কা না করে 'নগদ' যেহেতু গায়ের জোরে এতদূর আসতে পেরেছে আমার ধারণা এরা বন্ড ছেড়ে মার্কেট থেকে ৫০০ কোটি তোলার অনুমতিও পেয়ে যাবে। প্রাথমিক অনুমতি পেয়েও গেছে। কেন পাবেই না বলুন, যে সংস্থা এসব অনুমতি দেয় সেই সংস্থার (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন) চেয়ারম্যান, ঢাবি শিক্ষক শিবলী রুবাইয়াত নিজেই নগদ আয়োজিত আমেরিকার রোড শো তে গেছিলেন। এই আমেরিকা যাত্রার বিমানের টিকেট আর হোটেল খরচের ঋণ শোধ করার জন্য হলেও তিনি এই বন্ড ছাড়ার অনুমতি কোন বিধি নিষেধের তোয়াক্কা করে দিয়ে দিবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
কোন দেশের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জের প্রধানের সাথে কোন বন্ড ছাড়তে যাওয়া কোম্পানীর এত বড় কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট সম্ভবত শুধুমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব! এইদেশের শেয়ার মার্কেটে দুই দিন পর পর ধ্বস নামবে না তো কোনদেশে নামবে! এই শিবলী রুবাইয়াতের নামটা মনে রাখবেন। ঢাবি শিক্ষক আবুল বারাকাত জনতা ব্যাংকটাকে ডুবায়া গেছিলো না? এই শিবলী রুবাইয়্যাত নগদের 'বন্ড' স্ক্যামটার জন্য দায়ী থাকবে!
যাইহোক, সব চোরের মাঝে শুধু একটা সংস্থাই তাদের কাজ করছে ঠিকমত, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা নগদকে বলছে 'তুমি কিডা? হু আর ইউ? যাও ডাক বিভাগের নামে ৫১% শেয়ার দিয়া তাদের অনুমতি নিয়া আসো যদি TCSA এর মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ লেনদেন করতে চাও'! মাঝখানে এক মাস নগদের সাথে কোন ব্যাংকই লেনদেন করেনাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাঁপড় খেয়ে।
নগদ যে টাকা লেনদেনের পর তাদের কাছে জমা রাখে, মানুষ তো একসাথে সব টাকা একাউন্ট থেকে তুলে ফেলেনা, সেই টাকাটা তো সাধারণ মানুষের টাকা। পাবলিক মানি। সেইটা কোন আবুল কাবুল প্রধানন্ত্রীর পিএসের পরিচয়ে খোলা প্রাইভেট কোম্পানীর একাউন্টে রাখবে সেইটা তো হয়না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে এইটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, টাকা নিয়া নগদের মালিকেরা পলায়া গেলে কে সেইটা ফিরায়া আনতে পারবে! তাই বলছে আগে আসল মালিক নিয়া আসো, যেন কিছু হইলে ধরা যায়।
আর এতেই নগদ বাটে পরে গেছে। আসলে ডাক বিভাগকে তো তারা কোনদিনও সুডে নাই, জাস্ট নাম ইউজ করছিলো। অমুক তমুক হাই প্রোফাইলের ভিড়ে ডাক বিভাগের কেউ কোনদিন সাহস পায়নাই প্রশ্ন তুলতে! তারা ভাবেনাই যে বাংলাদেশ ব্যাংক এমন চোখ রাঙ্গানি দেবে, ভেবেছিলো এটা মগের মুল্লুক, পরিচয় পেয়ে সবাই চুপ থাকবে!
পরামর্শঃ
১. ভুলেও নগদের বন্ড কিনবেন না, যদি পারমিশন পেয়ে মাঠে বন্ড ছাড়েও। একটু মাথা খাটাইলেই দেখবেন নগদ এমন কোন স্যাটা হইলে তার দুই বছরে ৪১৬ কোটি টাকা ঋণ হইতো না, পর পর তিন বছর প্রফিট করার শর্তও তারা পূরণ করেনাই। নিজেই গুগল করে দেখে আসেন 'কিউ গ্লোবাল' কোম্পানীর এবাউট মি সেকশনে নিজেদের ব্যাপারে কি লেখা আছে!
২. নগদে বাধ্য হয়ে ট্রান্সফার করলে করবেন, কিন্তু টাকা সাথে সাথে তুইলা লইবেন! এইটার কিন্তু কোন কাগজপত্র ঠিক নাই। কোন লিখিত পারমিশন নাই, শুধুমাত্র গায়ের জোরে খুলা কোম্পানী। আতকা শুনবেন সবাই বিদ্যাশে গ্যাছে গা, গ্যালে গা কারো করার কিছু নাই।
৩. সরকারের প্রতি পরামর্শঃ বাংলাদেশ ব্যাংককে নিজের মত কাজ করতে দিন, যারা ফোন দেওন সুডাবে তাদের পরিচয় লিখে রাখুন, ডলার উপর রাখুন। আবার আরেকটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধরা খেলে লোকে তাদের বাদ দিয়ে কিন্তু সরকারকেই গালি দিবে!
লেখক : সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ডাটা ইঞ্জিনিয়ার, ইনফোসিস, যুক্তরাষ্ট্র।