বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

জাপানিজ সভ্যতা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে

রোববার, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১
জাপানিজ সভ্যতা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে

সৈয়দ জামান লিংকন : 

আমার এক বন্ধু প্রায়ই বলে, “দোস্ত আমাকে জাপান থেকে কয়েকজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এনে দে, আমি দেশে একটা স্কুল খুলবো যেখান থেকে বাচ্চাদেরকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।”

আমার বন্ধুর মত অনেকেরই ধারণা জাপানিজ সভ্যতার মূলে রয়েছে ওদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। জাপানের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা  পৃথিবীর অন্যতম সেরা এটা যেমন ঠিক তেমনি শুধু প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাই জাপানকে সভ্য দেশ হিসেবে গড়ে তুলছে না, এটাইও তেমনি ঠিক। 

আচ্ছা বলেনত, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা কি খারাপ? আমি, আপনি সবাই প্রাথমিকের গন্ডি পার হয়ে এসেছি, মনে করে দেখেন ত আমরা এমন কিছু কি শিখেছি, কিংবা আমাদের কে শেখানো হয়েছে যাতে বড় হয়ে আমরা খারাপ হতে পারি। আমার কিন্তু পরিষ্কার মনে আছে, অনেক ভালো ভালো এবং মজার মজার জিনিস আমরা শিখেছি।

“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি, আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে”, কিংবা

“আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে, তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে।”

জাপানে কিন্তু এত চমৎকার চমৎকার বাণী শেখানো হয় না। পড়াশুনার মান যদি বলেন তাহলে বাংলাদেশের প্রাথমিকের একটি বাচ্চার যে পরিমান পড়াশুনা করে জাপানিজ বাচ্চারা এভারেজে তাদের চেয়ে অনেক কম পড়ে। পড়াশুনার পার্থক্য বলতে আসলে, জাপানে পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে ব্যাবহারিকে জোড় দেয় অনেক বেশী। যেমন কৃষি বিষয়ক পড়াশুনার জন্য স্কুল মাঠেই ধান, সবজি, ফুলের বাগান করানো হয় ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে। বাচ্চাদের দিয়ে, স্কুল ঝাড়ু, টয়লেট পরিষ্কার করালেও এগুলোর সাথে সভ্য কিংবা মানবিক গুণাবলীর সম্পর্ক নগণ্য। যেমন আমার বাচ্চা জাপানের প্রাথিমক স্কুলে পড়াশুনা করলেও বাসায় কখনও টয়লেট, বাথরুম পরিষ্কার করে না, ইদানিং অবশ্য নিজের খাবার প্লেট নিজে পরিষ্কার করাসহ বাসার কাজে ঠুকঠাক সাহায্য করছে। 

জাপানের সভ্যতার মুলমন্ত্র কিছুটা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে আসলেও বেশীরভাগ আসে পারিবারিক এবং সমাজ থেকে।

জাপানের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রচুর পরীক্ষা নেয়া হলেও, কখনও মেরিট লিস্ট করা হয় না, অর্থাৎ ভালো ছাত্র আর খারাপ ছাত্র এই ভেদাভেদটা একেবারেই নেই। দুপুরের লাঞ্চ স্কুল থেকে সবার জন্য একই ধরনের খাবার সরবরাহ করা হয়, স্কুলের ব্যাগ দামের কিছু পার্থক্য হলেও দেখতে একই রকম, স্কুলে যেতে হয় পাড়ার স্কুলের বাচ্চাদের সাথে, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা সহ অনেক অনুস্টান হলেও এককভাবে কাউকে বিজয়ী করা হয় না। এসবগুলোর মুল উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই, তোমার সাথে তোমার বন্ধুর কোন পার্থক্য নেই, সবাই সমান। জাপানের স্কুলের বাচ্চারা জানে না তাদের বন্ধুদের বাবা মা কে কি করে, কিংবা কে কত টাকার মালিক, বড়লোকের বাচ্চাদের স্কুলে বড়লোকী দেখানোর কোন সুযোগ নেই।

জাপানের বাচ্চারা সভ্যতার মুল শিক্ষাটা পেয়ে থাকে তাদের পরিবার এবং সমাজ থেকে। আমার চোখে যে জিনিসগুলো ধরা পড়েছে

মান্যার জিনিসটা পুরুপুরি শেখাচ্ছে জাপানিজ বাবা-মায়েরা। 

১। জাপানে ট্রেনে চলার সময় প্রায়ই দেখা যায় বাবা-মা ছোট ছোট বাচ্চাদের বলছে, ট্রেনে কথা না বলতে, কান্না করলেও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে থামাতে যাতে পাশের যাত্রীর বিরক্তির কারন না হয়, অনেক সময় কান্না থামাতে না পারলে পাশের যাত্রীকে দুঃখিত বলে মাঝপথে নেমে পড়তে দেখা যায়। ট্রেনে ছুটাছুটি কিংবা সীটে জুতা নিয়ে বসতে দেখা যায় না কোন শিশুকে। 

২। বাবা-মা কত বেতনের চাকুরি করে কিংবা কত টাকার মালিক সেটা জানতে দেয়া হয় না, আমার বাচ্চারাও জানে না আমি কত বেতন পাই, তবে এতটুকু জানে বাবার অনেক কিছু কিনে দেয়ার সামর্থ্য নাই। 

৩। শপিংমলের কর্মচারী হউক আরা বাসার ক্লিনারই হউক, তাদেরকেও বাবা মায়ের সমান সম্মান করতে হয়, তাদের সাথে যে কোন পার্থক্য নেই সেটা বাচ্চারা বুঝতে পারে ওদের প্রতি বাবা মায়ের আচরণ থেকে। 

৪। বাচ্চাদের অন্যায় আবদারে সায় দেয় না, মোটকথা আললাদি নেই।

বাচ্চারা যদি ভুল করে সেক্ষত্রে শিক্ষক, বাবা-মায়ের পাশাপাশি সমাজও কিন্তু দায়িত্ব নেয়। একটা উদাহরণ দেই, বেশ কয়েকদিন আগে আমার বড় মেয়ের স্কুল থেকে একটা ই-মেইল এসেছিল, মেইলের বিষয়বস্ত ছিল, স্কুলের বাচ্চারা ট্রেন ষ্টেশনে বেশ উচ্চস্বরে কথা বলেছে বলে সাধারণ যাত্রী থেকে কমপ্লেইন এসেছে স্কুলে।

এসবের বাহিরে সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি নিয়েছে রাস্ট্র। বাচ্চারা পড়াশুনা শেষ করে যাতে প্রত্যেকেই নিজের পছন্দমত কাজ করতে পারে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাকুরীতে বৈষম্য দূর করেছে রাষ্ট্র। সরকারী চাকুরী মানেই ক্ষমতা, টাকা, অপরাধ করেও মাফ পাওয়া এগুলো জাপানে নেই। জাপানে মেধাবীরা সাধারণত বেসরকারি চাকুরিতে আগ্রহী কেননা বেতন এবং নতুন কিছু করার সুযোগ দুটোই বেশী বেসরকারি চাকুরিতে।সরকারী চাকুরী কে জাপানে নন প্রডাকটিভ হিসেবে ট্রিট করা হয়ে থাকে।

আমি দেশে কিছু সংগটনের সাথে জড়িত যেখান থেকে মেধাবী বাচ্চাদের বৃত্তি দেয়া হয়, একবার দেশে গিয়ে সেসব ছাত্রছাত্রী ও তাদের বাবা-মা দের নিয়ে একটা মতবিনিময় করেছিলাম। সেখানে একজন ছাত্রের মা হঠাৎ আমাকে অনুরুধ করল আমি যেন তার সন্তান কে বুঝাই যাতে সে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। আমি ভদ্র মহিলার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম সে কি পড়তে চায় এবং কেন। জবাব যা পেয়েছিলাম তার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ছেলেটি আমাকে জানিয়েছিল সে মানবিকে পড়তে চায় কারন তার ধারনা মানবিকে পড়লে সহজেই বিসিএস অফিসার হতে পারবে। অতি মেধাবী ছেলেটির জীবনের লক্ষ্য একটাই যেভাবেই হউক তাকে বিসিএস অফিসার হতে হবে।

আমার জাপানের হাই স্কুলে পড়ুয়া মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার কি জাপানের সরকারী চাকুরির জন্য কক্কা শিকেন (বিসিএস টাইপ) দেয়ার পরিকল্পনা আছে? মেয়ে একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দিয়েছিল বাবা আমি এসব নিয়ে ভাবছি না আর আমি যেহেতু বিজ্ঞান বিভাগে পড়ব তাই আমি সরকারী চাকুরী করব না।

আমি বাংলাদেশের ছেলেটিকেও দোষ দিচ্ছিনা আবার আমার মেয়েটিকেও ক্রেডিট দিচ্ছি না। দুজনের চিন্তা ভাবনার এই ব্যবধানটার জন্য ওরা দুজন কোনভাবেই দায়ী নয়।

জাপানের কুল, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই মিলেই কিন্তু জাপানের প্রতিটি বাচ্চাকে সভ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করছে, তাই হয়ত জাপানিজরা যুগ যুগ ধরে সভ্যই থেকে যাবে।

সৈয়দ জামান লিংকন : 
টোকিও 
সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল