ডা. রাসেল চৌধুরী :
মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতি কিছুটা কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হয়েছিলো। প্রথম প্রথম সব ছাত্র সংগঠনের নেতারাই রুমে আসতেন, কথা বলতেন।
আমি খুব অবাক হয়ে দেখতাম, সেখানে তরুণ নেতারা নবাগতদের সাথে ঘরোয়া রাজনৈতিক আড্ডায় রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে তেমন কোনো কথা বলতেন না। প্রতিপক্ষ নিয়ে ব্যক্তিচর্চা যতটুকু হতো, আদর্শিক পার্থক্যের আলোচনা তার সিকিভাগও হতো না।
বাংগালি জাতীয়তাবাদ নাকি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সেই বিতর্কের সমাধান কখনো সেখানে খুঁজতে দেখিনি।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য কতটুকু বরাদ্দ হলো বা নতুন জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি কেনো পুরনো স্বাস্থ্যনীতি থেকে ভালো সেটার আলোচনাও কখনো হয়েছিলো বলে শুনিনি। অথবা স্বৈরশাসক হলেও এরশাদ প্রণীত ওষুধনীতি কিভাবে এদেশের ওষুধ শিল্পে বিপ্লব নিয়ে এসেছিলো?
আর কোনো রাজনৈতিক বই পাঠের আসর বা আলোচনা? সেতো ধন্য আশা কুহকিনীর মতো অবস্থা!!!
আওয়ামী লীগ শাসন আমলে আমার মতো তরুণদের জন্য সবচেয়ে বড় রাজনীতি পাঠের উপকরণ হয়ে এসেছে বংগবন্ধুর নিজ হাতে লেখা অসাধারণ ৩ টি গ্রন্থ। অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমার দেখা নয়াচীন।
কতজন বংগবন্ধুর তরুণ সৈনিক সেগুলো আদর্শ শেখার জন্য পড়েছেন? চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলতে পারি শতকরা ১ জনও পড়েননি। না, কত কপি বিক্রি হয়েছে সেটা দেখে বোঝা যাবে না। কারণ অনেকেই সেগুলো অলংকার হিসেবে গায়ে চড়িয়েছেন ঠিকই কিন্তু হৃদয়ে ধারণ দূরের কথা, পড়েন নি পর্যন্ত। আর যারা পড়েছেন তাঁদেরও বড় অংশ পড়েছেন রাজনীতি বোঝার জন্য নয়, পড়েছেন বিসিএস বা অন্যান্য চাকরির পরীক্ষা পাশের জন্য।
আচ্ছা পড়ার কষ্ট বাদ দিন। বংগবন্ধুর প্রায় সব ভাষণ এখন ডিজিটাল ফরমেটেও একদম হাতের মুঠোতে। ইউটিউব, গুগলে সার্চ দিলেই শোনা যায়, দেখা যায়। কতজন ৭ই মার্চের ভাষণ ছাড়া বাকিগুলো পুরোটা দেখেছেন, রাজনৈতিক বক্তব্য বা বিতর্কের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছেন?
আচ্ছা অন্তত যে ১% বইগুলো পড়েছেন বা ভাষণগুলো দেখেছেন, তাঁরা এগুলোর কোনোটিতেও কি দেখেছেন বংগবন্ধু কাউকে গালি দিয়েছেন, খিস্তি খেউড় করেছেন? নারীদের নিয়ে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ে অশ্রাব্য কুৎসিত সব মন্তব্য করেছেন?
জীবনে প্রায় দুই দশক সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাঁকে জেলে আটকে রেখেছে, জেলে ফাঁসি দেবার আয়োজন পর্যন্ত করেছে যারা; স্বদেশের ৩০ লাখ লোকের জীবন আর সাড়ে ৭ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানি যারা করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের
রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও কি তিনি তাঁদের নিয়ে, তাঁদের পরিবারকে জড়িয়ে অশালীন মন্তব্য করেছেন?
করেননি। কারণ বংগবন্ধু সত্যিকারের রাজনীতি করতেন। প্রতিপক্ষের আদর্শকে অপছন্দ করা মানেই যে প্রতিপক্ষকে গালিগালাজ করা নয়, চরিত্রহনন করা নয়; অতটুকু না জানলে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংগালি হতেন না, বাংগালি জাতির পিতা হতে পারতেন না।
আর আপনি, আপনারা বংগবন্ধুর নাম ভাংগিয়ে, বংগবন্ধুর আদর্শকে ধুলোয় মিশিয়ে স্রেফ নিজেদের অর্জনকে ভারি করছেন। করেন অসুবিধা নেই। কারণ আজকের বাংলাদেশে তা অনেকেই করছেন।
কিন্তু ১৩ বছর ধরে এমপি হয়ে, মন্ত্রী হয়েও কি আপনি অন্তত রাজনৈতিক বিতর্কের ভাষাটুকু শিখবেন না? শালীন ভাষায় প্রতিপক্ষের সমালোচনা করে কয়েক মিনিট কথা বলতে পারবেন না? তবে কিসের রাজনীতি শিখেছেন, কিসের বংগবন্ধুর আদর্শ চর্চা করেন আপনি? এই যে নোংরা কথাগুলো বললেন, এতে দল কতটুকু এগোলো কিংবা সরকার? কতজন তরুণ আপনার এই কথাগুলো শুনে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি, আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতি, মন্ত্রীদের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হবে? নাকি উলটো আপনার ধিকৃত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সহানুভূতি পাচ্ছে?
যদিও আপনার আজকের রাজনৈতিক অবস্থানের বড় উৎসই হচ্ছে রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকার। আচ্ছা, আপনার স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা বাবা কি এই ভাষায় কথা বলতেন? আপনার সন্তান রাজকন্যাকে কি তাঁর প্রতিপক্ষ নিয়ে এই ভাষায় কথা বলার শিক্ষা দিতে চান?
বলতে পারেন, আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও তো এরকম খিস্তি খেউড় করে সংসদ বা টকশো কলংকিত করেছিলেন, এখনো করেন। তাহলে আপনি যে এত শিক্ষিত হওয়ার বড়াই করলেন অথচ বংকিমের সেই কথাটা একবারও আপনার মাথায় এলো না?
তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইবো কেন!!!
আসলেই কি উত্তম হবে আমাদের তরুণ রাজনৈতিক নেতারা? আমাদের প্রধান দলগুলোর এমন কোনো ছাত্রনেতা, যুবনেতা কি আছেন এখন যাদের কথা দশ মিনিট শুনলে বুকের মাঝে দেশকে ভালোবাসার, দেশের জন্য কিছু করার আগুন জ্বলে উঠে? উঠে না। আর জ্বলে উঠে না বলেই নূরু গংরা আজ স্থুল রাজনৈতিক হুংকার দিতে পারে। আপনারা বরং অমুক ভাই, তমুক ভাই গ্রুপের সহমত ভাইদের জন্মদিন পালন নিয়েই মশগুল থাকেন। আর প্রয়োজনমতো হুংকার, অশ্রাব্য খিস্তিখেউড়!!!
কবে আর বুঝবেন আপনারা!!!! নাকি এই নষ্ট সংস্কৃতিকে আদর্শ মেনে আরো নষ্ট হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামবেন!!!
রাজনীতিটাকে পারিবারিক সূত্রে নেতা বনে যাওয়া তরুণ নেতারাই যে অনাগত রাজনীতিবিদদের জন্য আরো কঠিন করে ফেলছেন, সেই আশংকার সুর কি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা শুনতে পাচ্ছেন? নাকি মেনেই নিয়েছেন, এদেশের রাজনীতিতে যায় দিন ভালো আর আসে দিন খারাপ, খুব খারাপ!!
যে ট্রেলার দেখছে বাংলাদেশ, পূর্ণ দৈর্ঘ্য রূপ প্রকাশ পেলে এদেশের নেতাদের রাজনৈতিক বক্তব্যগুলো দেখার আগে, শোনার আগে ডিজিটাল মিডিয়ায় ১৮+ হওয়ার বাধ্যবাধকতা হয়তো শিগগিরই আরোপ হবে।
হায় বাংলাদেশ, এমন নিয়তি নিয়ে জন্ম তোমার একাত্তরে!!!!!!!