আবদুন নূর তুষার :
এই কথাটি কাজী আনোয়ার হোসেন আমাকে তার জীবদ্দশায় লিখতে না করেছিলেন। আমি বললাম আপনি না থাকলে?
তিনি হেসে বললেন, তখন তো আমার কিছু পাবার নাই। এখন লিখলে বলবে কিছু চাই আমি।
তার সাথে কথা হয়েছিল তার জীবনের নানারকম গল্প নিয়ে একটি বই বের করার। উনি বললেন এসব আমার স্মৃতি। আমার কাছেই থাকুক। তবে রাজি হয়েছিলেন পরে। বলেছিলেন একটা ডিক্টেশন দেবেন।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ প্রকাশিত ছয়দফার প্রথম পুস্তিকাটি ছাপার জন্য প্রেস পাওয়া যাচ্ছিলো না। নিয়মিত যে প্রেসে কাজ হতো সেখানে পুলিশ নজর রাখছিলো। প্রেসের মালিক নিজেই নজরদারিতে।
ওই সময়টাতে ছিলো কঠিন পুলিশি পাহারা। নেতাকর্মীদের ওপর নেমে এসেছে সরকারি রোষ। তাই সেখানে ছাপলে পুলিশ কেড়ে নেবার ভয়।
সময়টা শাওয়াল মাস। ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ। ঈদের পর সেগুনবাগান প্রেসের কম্পোজিটর বাড়ী থেকে ফেরে নাই।
ছয়দফার পুস্তিকা কম্পোজ করলেন সেগুনবাগান প্রেসের ম্যানেজার ও কাজী আনোয়ার হোসেন নিজে। ছাপালেন গোপনে। নিজ হাতে। রাতে মেশিন চালিয়ে; বাইরে তালা মেরে।
বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ প্রথম পুস্তিকা আকারে ছাপা হলো সেবা প্রকাশনীর সেগুনবাগান প্রেসে।
জাতি এর প্রতিদান কাজী আনোয়ার হোসেনকে দিয়েছিলো।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সমর্থক একদল লোক তাকে পাকিস্তানপন্থী বানানোর চেষ্টা করেছিলো এই কথা বলে যে মাসুদ রানার বইতে তিনি ভারতীয় স্পাইদের কথা লিখেছেন। তিনি বোঝাতে না পেরে বই রি রাইট করেছিলেন। এই সমস্যা নূরুল ইসলাম সাহেব সমাধান করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে।
অভিমানে কাজী আনোয়ার হোসেন কখনোই এই পুস্তিকা প্রকাশের কথা কাউকে বলতেন না।
জাতি এই মানুষটিকে কোন স্বীকৃতি দেয় নাই। কোন পদক না। কোন সম্মাননা না। অথচ তার হাতের স্পর্শে সীসার ফন্টে ছাপা হয়েছিলো জাতির মুক্তির সনদ ১৯৬৬ সালে। বিরাট ঝুঁকি নিয়ে এটি করেছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ তো তখনই ছয় দফার বীজ বুনেছিলো।
কি চমৎকার তাই না?
তার মৃত্যুতে সংস্কৃতি কিংবা তথ্য মন্ত্রনালয় কি একটা শোকবার্তা দিয়েছিলো?
একটা সম্মান তাকে দিলে সোনাচুরির পদকে কি সোনা কম পড়তো? তার কফিনে বাংলাদেশের পতাকা?
এই অকৃতজ্ঞতায় মাথা হেঁট হয় আমাদের মতো কিছু মানুষের। এর চেয়ে বেশি আর কি!
এরকম অভিমানে একে একে সোনার মানুষেরা চলে যাবেন।
লেখক : চিকিৎসক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।