মিসবাহ জামিল
আমার একটা পঙক্তি আছে এমন ‘সবাই কমরেড বলে ডাকে মাগার ভাত দেয় না’। সদ্য প্রয়াত পার্থ মল্লিক উদীচী করতেন। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এ তথ্যটা তার ফেসবুক ঘেটে পেলাম। হয়ত বাহবা পেতেন খুব। উদীচী করার জন্য, একজন প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে। কিন্তু বাহবায় কি আর পেট ভরে? পেট এসব বাহবাটাহবা চায় না। চায় ভাত। ভাত জোটানোর লড়াইয়ে অনেকবার হেরেছেন পার্থ। হাল ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়াতে বাদ্য করল মৃত্যু। তাঁর অকাল প্রয়াণে শোক জানাই। চাই তার আত্মা শান্তি পাক। তরুণ কবির প্রয়াণে নিজের ভেতর একটা হাহাকার তৈরি হয়েছে। খুব কষ্ট হচ্ছে পার্থ মল্লিকের কথা ভেবে। তার সম্পর্কে তেমন জানি না। কথাটথা হয়নি কখনো, পরিচয় নাই। যে পরিচয়ে তাকে চিনি বলতে নামের সঙ্গে পরিচয় তা কবিতা লেখার জন্য। কবিতা লিখতেন। একটা বইও আছে তার। নাম ‘মানুষ রঙের পাখিরা’।
বেহুলাবাংলা প্রকাশন থেকে প্রকাশ হয়েছিল। সম্ভবত ২০২০ বা ২১ খ্রিস্টাব্দের বইমেলায়। তার অসুস্থতার খবরটা জানতে পারি সৈয়দ এনামুল তাজের মাধ্যমে। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে মন্তব্য করার পর তিনি ফোনে বিস্তারিত বলেন। তাজ ভাইয়ের কাছ থেকে আরও জানতে পারি, পার্থ মল্লিক অনার্স সম্পন্ন করে চাকরি খুঁজেছেন। এর-ওর কাছে ঘুরেছেন চাকরির জন্য। চাকরি পাননি। আমাদের মহান কবিসাহিত্যিকদের কাছেই ঘুরেছেন বেশি। যেহেতু তিনি কবিতালেখক। হয়ত ভেবেছিলেন কবিসাহিত্যিকদের দয়াপরবশ হতে পারবেন। কিন্তু কাজ হয়নি। কেউ তাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেননি অথবা দিতে পারেননি। পার্থের বাবা গানের পণ্ডিত। তিনি এলাকায় গান শেখান ছেলেমেয়েদের। এর বাইরে তাদের কোনো আয়ের উৎস নাই। পার্থ মল্লিক সুস্থ সুন্দর যুবকই ছিলেন। সোজা কথায় নিরোগ। হঠাৎ স্ট্রোক করেন গত ১ ফেব্রুয়ারি। তারপর আর জ্ঞান ফেরেনি। ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১২ টায় হাসপাতালে মারা যান। সংবাদ পেয়ে আমরা শোকে ফেসবুক ভাসাচ্ছি। আফসোস করছি। তাকে কি আমরা বাঁচাতে পারতাম না? বাকিদের কথা নাইবা বললাম। আমাদের অনেক কবিসাহিত্যিকরা ত উচ্চপর্যায়ে চাকরি করছেন। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীও তারা। তারা কি পারতেন না পার্থ মল্লিককে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে? একটা করপোরেট অফিসের বড় কর্তা বড় সাহিত্যিকও বটে। তার কাছে গেলেও ন্যুনতম পাত্তাও দেননি পার্থকে। এমনটা শুনে আমি নির্বাক হয়ে গেছি। অথচ কত নীতিকথা! সমাজ বদলানোর প্রয়াস তাদের মধ্যে পাওয়া যায়। নীতিকথার বাণী দিতে তারা বেশ পারদর্শী। সমাজকে বদলানোর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পার্থকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়াকে কেন সমাজ বদলানোর অংশ মনে হলো না? তা ভালা বলতে পারবেন আমাদের এসব মহান সাহিত্যিকরা।
আলমগীর কবিররা এদেশে ভাইরাল হন। পুলিশ চাকরির ব্যবস্থাও করে দেয়। কিন্তু পার্থ মল্লিকরা আড়ালেই ধুঁকে ধুঁকে মরেন। এদেশে পার্থ মল্লিকদের জন্ম নেওয়াই যেন অপরাধ। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তাদের সে অপরাধ মোচন করতে হয়। তারপর বলি, আমাদের এমপি-মন্ত্রী তথাকথিত জনদরদিদের কথা। যারা মুখে উন্নয়নের ফেনা তোলেন। দেশকে ইউরোপ-আমেরিকা-সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করেন। দেশে যে পার্থরা ধুঁকে ধুঁকে মরছে তারা কি দেখেন না বা জানেন না? নাকি এসব জানার পরও উপমা ব্যবহার করেন কবি হওয়ার খায়েশ থেকে। এমপি-মন্ত্রী হওয়ার চাহিদাটা ত পূরণ করেছেন ধান্দাবাজি করে। এখন কবি হওয়ার চাহিদা পূরণের চেষ্টা চালাচ্ছেন? পার্থ মল্লিকের মৃত্যুর দায় এ সমাজকে, সমাজব্যবস্থাকে নিতে হবে। এই সমাজ, সমাজব্যবস্থা আরও কতকত পার্থকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তার ঠিক হিসাব দেওয়া যাবে না। অথচ সামান্য ভূমিকা নিলে হয়ত পার্থ মল্লিককে অকালে প্রয়াত হতে হত না। পার্থর মা-বাবা দুজনেই অসুস্থ ছিলেন। তার ছিল অর্থকষ্ট, বেকার থাকার বিষন্নতা। এসবের চাপ থেকেই তার স্ট্রোক হয়। যার পরিণতি মৃত্যু। এদেশে জন্ম নেওয়া পার্থদের নিয়তি উন্নয়নের গান শুনে অকালে হারিয়ে যাওয়া। একদিন শোক জানিয়ে, আফসোস করে পার্থর মৃত্যুর দায় এড়ানো সম্ভব নয় আমাদের, সমাজের, সমাজব্যবস্থার। তবুও আমরা শোক প্রকাশের উদারতা দেখাই। পার্থ মল্লিকের একটা বোন আছে। আর আছে তার অসুস্থ বাবা-মা। নাই একরত্তি জায়গাজমি, বাঁচার কোনো অবলম্বন। এখন কে ধরবে সংসারের হাল? কী হবে তাদের? তারাও কি পুত্রশোকে-ভাইশোকে মরবেন নাকি অনাহারে মরবেন? আদতে শোকে মানুষ মরে না। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় বটে। গ্লানি নামের ছালা টেনে বেঁচে থাকে, বাঁচতে হয় বলে। সরকার তার পরিবারের দায়িত্ব নিক। এই আবেদন জানাই। আমাদের সবার উচিত পার্থ মল্লিকের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। দায়মুক্তি বলেও ত একটা ব্যাপার আছে।
লেখক ও কবি: মিসবাহ জামিল
সময় জার্নাল/আরইউ