প্রযুক্তি ডেস্ক:
এ বছরের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সংযুক্ত আরব আমিরাতে পৌঁছে কেবল খবরের শিরোনামেই আসেননি, বরং সঙ্গে এনেছিলেন চুক্তি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের শক্তিও।
ওই সময় প্রেসিডেন্টকে রাজকীয়ভাবে স্বাগত জানিয়েছিল দেশটি। তবে এ সফরের প্রকৃত কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিশাল আকারের নতুন এক এআই ক্যাম্পাস তৈরির ঘোষণা, যেটি আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগ বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নির্মিত সবচেয়ে বড় এআই অবকাঠামো কেন্দ্র হিসেবে ঘোষিত এ প্রকল্পটি থেকে ইঙ্গিত মেলে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এআই প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে সাহসী ও বড় পদক্ষেপ নিচ্ছে উপসাগরীয় দেশগুলো।
মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় কৌশলগত পরিবর্তনও ঘটিয়েছিলেন ট্রাম্প। এ পরিবর্তনের ফলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে মার্কিন চিপ নির্মাতা এনভিডিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী বিভিন্ন চিপ রপ্তানিতে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সেটিও শিথিল করেছে হোয়াইট হাউস।
ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায়, বর্তমানে উপসাগরীয় দেশগুলোকে কেবল বন্ধুই নয়, নিজেদের বড় প্রযুক্তি অংশীদার হিসেবেও বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিবিসি লিখেছে, নিজস্ব অর্থনীতি বা সরকারি খনিজ তহবিল, ভৌগোলিক অবস্থান, ও তেল ব্যবহার করে নিজেদেরকে এআই কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশ। তাদের এ পরিকল্পনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রযুক্তি। কারণ, ভবিষ্যতে তেল ও গ্যাস থেকে আয়ের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চাইছে তারা।
এ কাজে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তাদের এ কাজের মূল কেন্দ্র হচ্ছে ডেটা সেন্টার গড়া। আমিরাতের রাজধানী আবুধাবি ‘স্টারগেইট’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে চ্যাটজিপিটির নির্মাতা ও অন্যান্য মার্কিন কোম্পানির জন্য ‘ডেটা সেন্টার ক্লাস্টার’ বানানোর ঘোষণা দিয়েছে, যেখানে অনেক ডেটা সেন্টার একসঙ্গে মিলে থাকবে।
শত শত কোটি ডলারের এ চুক্তিটি অর্থায়ন করছে আমিরাতের সরকার সম্পর্কিত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘জি৪২’, যা দেশটির এআই পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করছে। আর তাদেরকে সবচেয়ে উন্নত চিপ সরবরাহ করবে এনভিডিয়া।
মার্কিন টেক জায়ান্ট সিসকো ও ওরাকলের পাশাপাশি জাপানের কোম্পানি সফটব্যাংকও ‘জি৪২’-এর সঙ্গে মিলে এ প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ করছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
‘খাজনা’ নামের আমিরাতের সবচেয়ে বড় ডেটা সেন্টার পরিচালক কোম্পানির সিইও হাসান আলনাকবি বলেছেন, “এমিরেটস বিমান সংস্থা যেমন আমিরাতকে বিশ্ববাজারে বিমান চলাচলের কেন্দ্র করে তুলেছে তেমনভাবেই এখন এআই ও ডেটার সেন্টার নির্মাণের ক্ষেত্রেও বড় কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে দেশটি।”
‘খাজনা’র অধিকাংশ মালিকানা রয়েছে ‘জি৪২’-এর কাছে, যেটি ‘স্টারগেইট’ প্রকল্পের জন্য অবকাঠামো তৈরি করছে। বর্তমানে আমিরাতজুড়ে ২৯টি ডেটা সেন্টার পরিচালনা করছে কোম্পানিটি।
আমিরাত ও সৌদি আরব চাইছে, শক্তিশালী এআই মডেল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ডেটা সেন্টার তাদের দেশেই গড়ে তোলা হোক। ওয়াশিংটনের ‘মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট’-এর সিনিয়র ফেলো মোহাম্মদ সোলিমান বলেছেন, “কম্পিউটিং সক্ষমতা এখন নতুন তেলের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
এআইয়ের জন্য কম্পিউট বলতে বোঝায় বিশাল আকারে হিসাব করার সক্ষমতা, যা তৈরি হয় উন্নতমানের চিপ ও বড় বড় ডেটা সেন্টারের মাধ্যমে। এখন এ ধরনের বড় প্রযুক্তি গড়ে তুলতে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশ।
বিবিসি লিখেছে, আগে শিল্পায়নে যেমন তেল গুরুত্বপূর্ণ ছিল আজকের এআইনির্ভর যুগে ডেটা সেন্টার ও শক্তিশালী কম্পিউটারের মতো অবকাঠামো হচ্ছে তেলের মতোই গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানী।
সোলিমান বলেছেন, গত শতকে উপসাগরীয় বিভিন্ন তেল কোম্পানি ঠিক যেমন বিশ্ব অর্থনীতি চালিয়েছিল এখন সেই অঞ্চলের বিভিন্ন এআই কোম্পানি কম্পিউট সক্ষমতা দিয়ে ২১শ শতকের বিশ্ব অর্থনীতি চালাতে চাইছে।
গত কয়েক বছরে বিদেশি বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিতে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে উপসাগরীয় দেশের বিভিন্ন ফান্ড। তবে এখন এসব দেশ সরাসরি অংশ নিয়ে আগ্রাসী অংশীদার হিসেবে কাজ করার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
‘হিউমেন’ নামের নতুন এক এআই কোম্পানি খুলেছে সৌদি আরবের ‘পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড’ বা পিআইএফ। তারা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কয়েক লাখ এনভিডিয়া চিপ ব্যবহার করে ‘এআই তৈরির বড় অবকাঠামো’ বানানোর পরিকল্পনা করছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
‘জি৪২’ ও ‘এমজিএফএক্স’কে অর্থ দিয়ে সমর্থন জুগিয়েছে আমিরাতের সরকারি মালিকানাধীন বিনিয়োগ কোম্পানি ‘মুবাদালা’। এমজিএফএক্স মাইক্রোসফটের সঙ্গে এক হাজার কোটি ডলার মূল্যের এআইয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়া এক যৌথ উদ্যোগ। এ ছাড়া, অন্যান্য স্থানীয় বিভিন্ন প্রকল্পকেও সহায়তা করছে তারা।
তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের জন্য দক্ষ এআই বিশেষজ্ঞ বা জনশক্তি পাওয়া এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিদেশি কোম্পানি ও গবেষকদের জন্য কম খরচে ও দীর্ঘমেয়াদি ‘গোল্ডেন ভিসা’ এবং সহজ নিয়ম-কানুনের ব্যবস্থা করছে আমিরাত।
আমিরাতভিত্তিক এক এআই স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা ও একজন ভেঞ্চার বিনিয়োগকারী বাগদাদ ঘেরাস বলেছেন, “দেশে বিশ্বমানের ডিজিটাল ও এআই সুবিধা তৈরি করলে সেটা অনেককে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করবে।”
এখনও পর্যন্ত উপসাগরীয় অঞ্চলে ওপেনএআই, মিস্ট্রাল বা ডিপসিকের মতো বিশ্বমানের কোনো এআই কোম্পানি তৈরি হয়নি এবং তাদের কাছে এখনো পর্যাপ্ত গুণগত গবেষক বা বিশেষজ্ঞও নেই বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
ঘেরাস বলেছেন, আমিরাতের জনসংখ্যা কেবল এক কোটির বেশি অর্থাৎ দেশটিতে কম মানুষ থাকায় এখানে বড় মাপের গবেষণা পরিবেশ গড়ে তোলা একটু কঠিন।
উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশ যখন এআই ক্ষেত্রে বড় আশা নিয়ে এগোচ্ছে তখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার প্রযুক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা মরুভূমির মধ্যেও দেখা যাচ্ছে।
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের ফলে উপসাগরীয় অঞ্চলের এআই দৌড়ে এগিয়ে গেল ওয়াশিংটন। তবে এর জন্য কিছু মূল্যও দিতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পরিবর্তনের অংশ হিসেবে কিছু চীনা সমর্থিত প্রকল্প কমানোর পাশাপাশি ও হুয়াওয়ের হার্ডওয়্যারের ওপর নির্ভরতাও কমিয়েছে আমিরাত।
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় এআই সংক্রান্ত যেসব চুক্তি হয়েছে তা থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, এখন মার্কিন কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে প্রযুক্তি।
পরম্পরাগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশের সম্পর্ক তেল বিনিময় ও নিরাপত্তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও এই সম্পর্ক এখন বদলে গিয়ে শক্তি, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির দিকে এগোচ্ছে।
সোলিমান বলেছেন, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় যেসব এআই চুক্তি হল সেগুলো মূলত ‘উপসাগরীয় দেশের মধ্যে নয়, বরং চীনের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ’।
“সম্ভাবনাময় ও দ্রুত উন্নয়নশীল এক এআই অঞ্চল হচ্ছে উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশ। ফলে এসব দেশকে নিজেদের ‘টিম আমেরিকা এআই’ দলের সঙ্গে যোগ করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র।”
এদিকে, ঘেরাস বলেছেন, চীনের বদলে আমেরিকাকে বেছে নেওয়ায় উপসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের জন্য এক যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল।
“বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রই এআই খেলার নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই আমিরাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলানো ভালো সিদ্ধান্ত।”
তবে রয়টার্স বলেছে, হাজার কোটি ডলারের স্টারগেইট চুক্তিটি এখনও নিরাপত্তা অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করছে। কারণ মার্কিন কর্মকর্তারা বিবেচনা করছেন, আমিরাতের ডেটা সেন্টারে চীনের কোনো ব্যক্তি বা প্রযুক্তি ব্যবহার হতে পারে কি না তা নিয়ে।
তবুও এ প্রকল্পটি এগিয়ে চলবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ কোম্পানি এ প্রকল্পের পক্ষে জোট বেঁধেছে মার্কিন বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি।
বর্তমানে এআইতে মার্কিনিরা এগিয়ে থাকলেও সোলিমান সতর্ক করে বলেছেন, এক্ষেত্রে চীনকে হালকাভাবে দেখাটা একেবারেই ঠিক হবে না।
“চীন খুব দ্রুত এগোচ্ছে। এরইমধ্যে নিজস্ব এআই প্ল্যাটফর্ম রয়েছে দেশটির। সেটি যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী না হলেও অনেক সাশ্রয়ী। আর অনেক দেশের জন্য সেটিই যথেষ্ট।”
তবে এখনকার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশ উভয়পক্ষই পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উপকার পাচ্ছে।
এমআই